আমার দেখা দেশের অন্যতম সুন্দর শহর খুলনা। যানজটমুক্ত, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন চমৎকার একটা শহর। এ আর্টিকেল যখন লিখছি তখন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আর মাত্র দুসপ্তাহ বাকি। সেতু উদ্বোধনের সাথে সাথে বদলে যাবে অনেক হিসেব-নিকেশ। নি:সন্দেহে গতি পাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের পর্যটন। এ অঞ্চলের পর্যটনকে কেন্দ্র করে আমরা বেশ কিছু আর্টিকেল লিখবো, আজ তার প্রথম পর্ব খুলনা নিয়ে।

চাকরিসূত্রে আমি দুবছর খুলনায় বসবাস করেছি। তার আলোকে খুলনা শহরের আশেপাশে দেখার মতো জায়গা, থাকার জায়গা নিয়ে লিখছি। খুলনার মজাদার খাবার বিশেষত চুইঝাল নিয়ে আলাদা একটা লেখা আছে আমাদের সাইটে, সেটার লিংক। দুই তিন দিন সময় হাতে নিয়ে গেলে খুলনা শহর আর আশেপাশে ঘুরে দেখতে পারবেন।

রূপসা ব্রীজ: খুলনার শহরের ল্যান্ডমার্ক বলা যায় এ রুপসা ব্রীজকে, যার প্রকৃত নাম খান জাহান আলী সেতু। নদীর দুপাড়েই বিকেলে প্রচুর দর্শনার্থীর ভিড় হয়। আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে শহরের প্রান্তের চেয়ে নদীর অপর পাড়ের অংশটা বেশি ভালো লাগে। চাইলে ব্রীজের এ পাড়ে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে হেটে ব্রীজের অপর পাড়ে চলে যেতে পারেন। এছাড়া অটো দিয়েও পার হওয়া যায় ব্রীজ। শহরের যে কোন জায়গা থেকে রূপসা ব্রীজের নিচে আসতে ত্রিশ মিনিটের কম সময় লাগবে।

চরের হাট: শহর দেখে একটু দূরে নগরীর পুরণো অভিজাত এলাকা খালিশপুরের কাছে চরের হাট। বিকেল বেলা এ জায়গাটার সৌন্দর্য দেখার মতোই বটে। এখানে ভৈরব নদ মিলিত হয়েছে রূপসার সাথে। ভৈরব নদ পার হয়ে ওপারে চন্দনীমহল গুচ্ছগ্রামের নদীর পাড়টা বেশি সুন্দর। একপাশে রপসা আরেক পাশে ভৈরব নদীর এ অংশটায় বসে কাটিয়ে দেয়া যায় সারাটা বিকেল। সূর্যাস্তের লাল আভা নদীর উপর ভেসে যাওয়া মেঘে অপার্থিব এক দৃশ্যের জন্ম দেয়।
যেতে চাইলে শিববাড়ী মোড় থেকে অটো নিয়ে আলমনগর পৌছাতে ২০ মিনিট সময় লাগবে। আর নৌকা জনপ্রতি ৫ টাকা ভাড়া দিয়েই পার হওয়া যায়, বেশি সময় ঘুরতে চাইলে ঘন্টা হিসেবে বৈঠার নৌকা ভাড়া করতে পারেন, ২০০/৩০০ টাকা নিবে।

৭ নং ঘাট: মূলত ভৈরব নদের কোলঘেঁষে ৬ ও ৭ নং ঘাট নিয়ে গড়ে উঠেছে এই এলাকা। বসার জায়গা ছাড়াও গড়ে উঠেছে অসংখ্যা খাবারের দোকার। চাইলে নৌকা নিয়েও ঘোরা যায় এখান থেকে। আর কোনদিন কপাল ভালো থাকলে দেখা মিলবে ইরাবতী ডলফিনের (শুশক)। শিববাড়ি মোড় থেকে জোড়া গেইট পার হয়ে যেতে হয় ৭ নং ঘাট। তবে এ জায়টায় ইদানিং একটু বেশি ভিড় হয়, তাই অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে।

বটিয়াঘাটা: খুলনা শহরের বেশ কাছে উপজেলা বটিয়াঘাটা। রূপসা নদীর তীর ঘেঁষে বটিয়াঘাটা-চালনা সড়ক সম্ভবত খুলনার সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা। এ রাস্তায় মোটরসাইকেল/সাইকেল চালিয়ে গেলে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগবে। বটিয়াঘাটার বাইপাস এলাকায় গড়ে উঠেছে রানা রিসোর্ট এন্ড এমিউজমেন্ট পার্ক। চাইলে সেখান থেকেও ঘুরে আসতে পারেন, দেশের প্রথম সুনামিপুল আছে এই রিসোর্টে। নগরীর গল্লামারী বাজার/জিরো পয়েন্ট থেকে অটোতে করে যেতে পারবেন ১৫ কিমি দূরের বটিয়াঘাটায়। সময় লাগবে ৩০ মিনিটের মতো।

দক্ষিণডিহি: কবিগুরু ররীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরালয় দক্ষিণডিহি। সাম্প্রতিক সময়ে বাড়িটির কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে। কবিগুরুরর স্মৃতি বিজড়িত এ ঐতিহাসিক স্থাপণাটি অনেকের খুব পছন্দের জায়গা। খুলনা শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে ফুলতলা উপজেলায় এর অবস্থান। কবিগুরুর মা সারদা সুন্দরীও এ গ্রামের মেয়ে ছিলেন। কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সাথে বিবাহসূত্রে কয়েকবার এখানে এসেছিলেন তিনি।

হাদিস পার্ক: খুলনা শহরের মধ্যে বাবু খান রোডে অবস্থিত হাদিস পার্ক একটি ঐতিহাসিক স্থাপণাও বটে। এর মধ্যে শহীদ মিনার ও পাশেই নগরভবন রয়েছে। ১৯৬৯ সালের আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত শেখ হাদিসুর রহমানের নামে এ পার্কের নামকরণ করা হয়েছে। এখানকার ওয়াচ টাওয়ারে উঠে পুরো পার্ক পাখির চোখে দেখতে পারবেন। খুব ভোরে নগরীরর স্বাস্থ্য সচেতন মানুষরা ভিড় করে এখানে।

সুন্দরবন: খুলনার সাথে সুন্দরবনের নাম ওতোপ্রোতেভাবে জড়িয়ে আছে। তবে সুন্দরবন বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা তিন জেলা জুড়েই বিস্তৃত। খুলনা থেকে সুন্দরবন ভ্রমণ করতে চাইলে দু্ই/তিনদিনের প্যাকেজ কিনতে পারবের সদরঘাট এলাকা থেকে। খরচ পড়বে মানভেদে ৭,০০০ থেকে শুরু করে ১৫,০০০ টাকা জনপ্রতি। সাধারণ রূপসাঘাট থেকেই এ প্যাকেজগুলো শুরু হয়ে সুন্দরবনের কটাক-কচিখালী ঘুরে আবার রূপসাঘাটে এসে শেষ হয়।

আর একদিনের জন্য ঘুরতে চাইলে চলে যেতে হবে মোংলা। সোনাডাঙ্গা থেকে এক ঘন্টায় বাসে করে মোংলা পৌছে সেখান থেকে ডে-ট্রিপের জন্য নৌকা ভাড়া করে করমজল বা হাড়বাড়িয়া ঘুরে আসতে পারবেন। দরদাম করে সাইজ অনুসারে নৌকা ১,৫০০ থেকে ৩,০০০ টাকার মধ্যে পাবেন। করমজলে কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র আছে, সেখানে কুমির দেখতে পারবেন। আর চাইলে ফেরার সময় ষাট গম্বুজ মসজিদও ঘুরে আসতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ফেরার পথে প্রথমে মোংলা থেকে যেতে হবে ষাট গম্বুজ মসজিদ, তারপর সেখান থেকে খুলনা ফিরতে পারবেন।
যাতায়াত: ঢাকা থেকে খুলনার গাড়ি এতদিন মাওয়া ও পাটুরিয়া ফেরী ঘাট হয়ে চলাচল করছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়ে গেলে শুধু মাওয়া হয়েই চলবে বেশিরভাগ গাড়ি। বর্তমানে বেশিরভাগ নন এসি বাসের ভাড়া ৬০০-৭০০ টাকার মধ্যে। গুলিস্তান ফুলবাড়ী বাস স্ট্যান্ড থেকে টুংগিপাড়া এক্সপ্রেস, ফাল্গুনী, সেবা গ্রীনলাইন সহ বেশ কয়েকটি বাস ছাড়ে। পদ্মা সেতুর হয়ে গেলে এ ভাড়া বেড়ে দাঁড়াবে ৬৫০ টাকা। তবে ফেরী/লঞ্চ আর থাকবেনা, ফলে সময় কমবে অনেক। বর্তমানে এসি বাসের মধ্যে সোহাগ ও হানিফ রয়েছে যেগুলোর ভাড়া ১,২০০-১,৩০০ টাকা।

এছাড়া ট্রেনেও যাওয়া যায় খুলনা। ঢাকা-খুলনার মধ্যে চিত্রা ও সুন্দরবন এক্সপ্রেস চলাচল করে। রাতে যারা ঢাকা থেকে যেতে চান তাদেরকে সন্ধ্যা ৭ টায় উঠতে হবে চিত্রা এক্সপ্রেসে উঠতে হবে যা ভোররাত ৩ টার পরে খুলনা পৌছাবে। অপরদিকে সুন্দরবন এক্সপ্রেস সকাল ৮:১৫ তে ঢাকা থেকে ছেড়ে পৌছাবে বিকেল ৫ টার পর। খুলনা থেকে চিত্রা এক্সপ্রেস সকাল ৯ টায় খুলনা থেকে ছেড়ে সন্ধ্যা ৬টায় পৌছায় আর সুন্দরবন এক্সপ্রেস রাত ১০ টায় ছেড়ে ভোরের দিকে ঢাকা পৌছাবে। ভাড়া সর্বনিন্ম ৫০৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১,৫০৫ টাকা।
থাকার জায়গা: খুলনায় সবচেয়ে ভালো হোটেল সিটি ইন যেটা নগরীরর শিববাড়ী মোড়ের কাছে অবস্থিত। এছাড়া হোটেল রয়েল, টাইগার ইন, ক্যাসল সালাম, সিএসএস আভা সেন্টার, মিলেনিয়াম, ওয়েস্টার্ণ ইন সহ অনেকগুলো হোটেল রয়েছে। হোটেলের মান ভেদে ভাড়া ১৫০০ টাকা থেকে শুরু করে একেবারে ৬,০০০ টাকা পর্যন্ত আছে। এর কমেও হোটেল পাবেন সোনাডাঙ্গা ও বড় বাজার এলাকায়।
ফিচার ছবি লেখক
অনবদ্য
ধন্যবাদ