বর্ষার মৌসুম আসছে। আর বর্ষা মানেই ঝর্ণাগুলোর যৌবন শুরু। প্রচুর মানুষ এখন ঝর্ণার খোঁজে বুনো পথে হাটবেন। বেশ কিছু ঝর্ণা এবার আছে আমার বাকেট লিস্টে। আবার অনেকগুলো ঝর্ণা দেখাও হয়েছে। আমার দেখা ঝর্ণাগুলোর মাঝে পছন্দের দশটি ঝর্ণা নিয়েই লিখছি এই লেখাটা।

১. ঝরঝরি: সীতাকুন্ড-মীরসরাই রেঞ্জকে বাংলাদেশের ঝর্ণার স্বর্গ বলা যায়। ঢাকা থেকে যেতে তেমন সময় লাগেনা বিধায় সীতাকুন্ডের প্রায় সব ট্রেইলে যাওয়া হয়েছে। তবে সবকিছুর মাঝে ঝরঝরি ট্রেইল এবং ঝর্ণাটা আলাদাভাবে নজর কেড়েছে আমার। এই ঝর্ণার পাশ দিয়ে পাহাড় উঠে আরো কিছু ঝর্ণা আর ক্যাসকেইড আছে। পুরো ট্রেইল শেষ করতে ঘন্টা পাঁচেক লেগে যায়। ঢাকা থেকে বাসে করে মিরসরাই পার হয়ে পন্থিছিলা বাজারে নামতে হবে। পন্থিছিলা থেকে ঝরঝরি ট্রেইল পর্যন্ত হেঁটে আসতে দেড় ঘন্টার মত সময় লাগে। সীতাকুন্ডে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডে-ট্যুর দেয়া যায়।

২. ধুপপানি: ধুপপানি ঝর্ণা রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের ওড়াছড়ি নামক স্থানে অবস্থিত। অনেকে এটিকে দুপপানি ঝর্ণা নামেও ডেকে থাকেন। তঞ্চঙ্গ্যা শব্দে ধুপ অর্থ সাদা অর্থাৎ সাদা পানির ঝর্ণা। এই ঝর্ণার মূল আকর্ষণ আমার কাছে ঝরনার নীচের গুহাটা। চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগে। ঢাকা থেকে কাপ্তাই নেমে সেখান থেকে ট্রলারে করে বিলাইছড়ি যেতে হয়। বিলাইছড়িতে থাকার ব্যবস্থা আছে। এখান থেকে আবার দুই আড়াই ঘন্টা ট্রলারে উলুছড়ি। এরপর কোষা নৌকায় করে ট্রেকিং পয়েন্টে পৌঁছাতে হয়।

৩. লাংলোক: উচ্চতার দিক থেকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ঝর্ণা লাংলোক প্রায় ৩৮৮.৯ ফুট। থানচি উপজেলার এই ঝর্ণার স্থানে একটি বাদুড় গুহা থাকার ফলে মারমা ভাষায় এই ঝর্ণাকে লাংলোক (অর্থাৎ বাদুড়) বলে ডাকে। তিন্দু বড় পাথর এলাকা থেকে লাংলোক যেতে ঘন্টা দুয়েক সময় লাগে। চারদিকের উঁচু পাহাড়ের মাঝে থেকে নেমে আসা এই ঝরনার বিশালতাটাই মনোমুগ্ধকর।

৪. নাফাখুম-আমিয়াখুম: বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলায় অবস্থিত চমৎকার দুইটি জলপ্রপাত নাফাখুম-আমিয়াখুম। খুম মানে জলপ্রপাতে সবসময় পানি থাকে। অক্টোবর থেকে মার্চ সবচেয়ে ভালো স্বচ্ছ নীলচে সবুজ পানির খুম দেখার জন্য। দুইটি রুটে এখানে যাওয়া যেতে পারে। থানচি থেকে পদ্মঝিরি হয়ে আমিয়াখুম অথবা থানচি থেকে রেমাক্রি হয়ে নাফাখুম দেখে আমিয়াখুম। অনেকে পদ্মঝিরি দিয়ে যেয়ে রেমাক্রি দিয়ে চলে আসেন। পাহাড়ি পাড়াগুলোতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।

৫. দামতুয়া: বান্দরবান জেলার আলিকদম উপজেলায় অবস্থিত এই ঝর্ণা আকৃতি এবং সৌন্দর্যের দিক থেকে আমার অন্যতম পছন্দের। যদিও তুলনামূলক কষ্টকর, তবে ট্রেইলটা খুবই সুন্দর। ট্রেকারদের কাছে ব্যাঙ ঝিরির আবেদন অনেক। দামতুয়ার পথে ওয়াংপা ঝরনাও দেখে আসেন অনেকে। আলিকদম-থানচি সড়কের ১৭ কিলো পয়েন্টের আদুপাড়া থেকেই গাইড নিয়ে দামতুয়ার ট্রেকিং শুরু হয়।

৬. সাইংপ্রা: বান্দরবান জেলার আলিকদম উপজেলার চিম্বুক রেঞ্জের কির্সতং পাহাড়ের কাছে এই ঝর্ণার অবস্থান। এই ঝর্ণার তিনটি ধাপ আছে। আমার দেখা ঝর্ণাগুলোর মাঝে সাইংপ্রা ট্রেইল যেমন বুনো, তেমনই সুন্দর। অনিন্দ্যসুন্দর এই ঝর্ণা দেখার সাথে কির্সতং-রুংরাং পাহাড় সামিট করে আসা যায়। আলিকদমের দুসরি বাজার থেকে ট্রেকিং করে মেনকিউ পাড়া, মেনিয়াংক পাড়া হয়ে খেমচং পাড়া যেয়ে থাকতে হয়৷ এই পাড়া থেকেই সাইংপ্রার উদ্দেশ্যে ট্রেকিং শুরু হয়। অনেকটা পথ এবং খুব দূর্গম তাই খুব সকালেই বের হওয়া ভালো।

৭. পালংখ্যিয়ং: আলিকদম উপজেলার আরেকটি সুন্দর ঝর্ণা পালংখ্যিয়ং। তৈনখালের দীর্ঘ পাথুরে পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় এই ঝর্ণা দেখতে। বর্ষায় তৈনখাল প্রচন্ড খরস্রোতা। তাই এই ঝর্ণাও তখন খুবই বিপদজনক। পালংখ্যিয়ং এর আপারস্ট্রীমের কাছে ক্যাম্পিং করে থাকা যায়, হ্যামকে দোল খাওয়া যায়।

৮. লুংফেরভা সাইতার: লুং ফের ভা সাইতার বান্দরবানের সিলোপি পাড়ায় অবস্থিত একটি বিশাল ঝর্ণা। অত্যন্ত দূর্গম এই ঝর্ণার ট্রেইল। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। ঝর্ণাটার মূল সৌন্দর্য এর গঠন। সবুজ গাছগাছালির ফাঁকে স্বচ্ছ পানির ধারা অন্যরকম সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেয়।

৯. ডাবল ফলস: ডাবল ফলস বা ত্লাবং ঝরনা বান্দরবান জেলার এমন একটি জলপ্রপাত যা জোড়া ঝর্ণা নামেও পরিচিত। এটি রেমাক্রি খালের উৎস। দুটি প্রবাহ প্রাংশা (বামে) ও পাংখিয়াং (ডানে) ঝিরি মিলে দুটি আকর্ষনীয় জলপ্রপাত তৈরী হয়েছে। দুইটা ঝর্ণা একসাথে থাকার কারণে একে ডাবল ফলস বলে। সুংসাং পাড়া আর থাইক্ষ্যং পাড়ার মাঝের জঙ্গলে অবস্থিত এই ঝর্ণাটি।লুংফেরভা এবং ডাবল ফলসের সাথে এদিকে ঝর্ণার রাণী নামে খ্যাত জাদিপাই এবং দেশের অন্যতম উঁচু ঝর্ণা বাক্তলাইও দেখে আসা যায়। তবে এই ঝর্ণাগুলোর সহজ রুটের অনুমতি দেয়া হয়না বলে অনেক ঘুরে যেতে হয় এবং তাই এগুলোর ট্রেকিংটাও কষ্টসাধ্য।

১০. তিনাপ সাইতার: বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে অবস্থিত প্রশস্ততার দিক থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত। অনেকের কাছে এটি পাইন্দু সাইতার নামেও পরিচিত। পাইন্দু খালে এর অবস্থান। পাহাড়ি পথ আর পাইন্দু খাল পার হয়ে তিনাপ যেতে হয়। রোয়াংছড়ি থেকে রনিনপাড়া যাওয়া যায় বাইকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং পরিচ্ছন্ন পাড়া নামে পরিচিত এই রনিনপাড়ায় রাতে থেকে পরদিন সকালে তিনাপের উদ্দেশ্যে ট্রেকিং শুরু হয়। এদিকে, রুমা থেকে যদি অনুমতি নেয়া যায়, তাহলে আত্তাপাড়া হয়ে তিনাপ যাওয়া একেবারেই কম সময় লাগে এবং ট্রেকিংও সহজ।
ফিচার ছবি সহ সব ছবি লেখিকা