তখনও যাত্রাবাড়ি ফ্লাই ওভার হয়নি। চৌরাস্তায় ছিল চতুর্মুখি ফুট ওভার ব্রিজ। খাওয়া পর্ব শেষে বললাম দাদু ভাইকে সোনারগাঁ যাব আমার খালা থাকে সেখানে, কি ভাবে যাব৷ দাদু ভাই হেসে বললেন ওই যে ওপারে গিয়ে দাঁড়াও মোগরাপাড়ার বাস পাবা৷ ওইটা চইড়া যাও৷ মোগড়াপাড়া থেকে তো কাছেই৷ সোনারগাঁয়ে কুন জায়গায় তুমার খালার বাড়ি৷ দাদুর কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলুম তবে মুখে সাহস নিয়ে বলে ফেললাম জাদুঘরের কাছাকাছি৷ আমি গেলে চিনতে পারবো৷ মৃদু সন্দেহ উদয় হবার আগেই আমি সেখান থেকে চম্পট এবার উঠে বসলাম মোগড়া পাড়ার বাসে৷
বাস সে তো এক চলন্ত গল্প৷ কত মানুষ উঠে, কত মানুষ নামে। তবে নামে না আজিজ ভাই। জ্বি আজিজ ভাইয়ের সাথে সে প্রথম দেখা। মোগড়াপাড়ের বাসেই রচিত হয়েছিল আমাদের বন্ধুত্বের সূচনা৷ বাসে উঠে সিট খালি পেয়ে বসলাম। পাশে চেয়ে দেখি উস্কো খুস্কো চুলের আধা কাচা দাঁড়ির এক পয়ত্রিশ ঊর্ধ্ব মানুষ বসে আছে৷ চোখে সান গ্ল্যাস, পরনে কাক তাড়ুয়ার মত ধুসর রঙের ফতুয়া কাম পাঞ্জাবি, রোদে সাদা চানড়া তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। তার এক হাতে এক তারা, গলায় রুদ্রাক্ষমালা। যেন অচিনপুর থেকে উঠে আসা প্রাণী৷

বাস চলছে, আজিজ ভাই দুলছে৷ ঘুমাচ্ছে শিশুর মত, গাল বেয়ে লালার শিরা বেয়ে দাঁড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছে তার ভ্রূক্ষেপ নেই৷ দুলুনি দিয়ে বার বার আমার গায়ের দিকে সরে আসেন আর আমি ইয়াকি একটা ভাব নিয়ে চেপে চেপে যাই৷ মানুষ একতারা হাতে নিয়ে ঘুমায় কেমনে ইহা আসলে সপ্ত আশ্চর্য৷ বাসের হার্ড ব্রেকে সামনের দিকে ঝুঁকে ললাটে মৃদু আঘাত না করলে কে ভাঙ্গাতো তার ঘুম৷ জগৎপিতাই ঘুম ভাঙ্গানিয়া পাখির ভূমিকায় নামলেন৷
আজিজ ভাইয়ে বাদামি চোখে একেবারে শিশুর মায়া। আশেপাশে চেয়ে আমার দিকে তাকালেন এবং বলে উঠলেন, ‘হেই ব্রাদার আমার কোথায় এখন?’ আমি বললাম, ‘চিনি না৷’ আমি মোগড়াপাড়া নামবো। আজিজ ভাইয়ের চোখে ঝিলিক, ‘আমিও মোগড়া পাড়া নামবো। সোনারগাঁ যাবে বুঝি।’ আমি ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম৷ এরপর উনি যা করলেন কোন নারী সমাজের প্রতিনিধি সেখানে থাকলে হয়তো তাদের গা রি রি করে উঠতো৷ পরনের ফতুয়ার আগা দিয়ে দাঁড়ির সিরা মুছলেন, মুছলেন মুখের ঘাম এরপর নাকের সর্দি আসি আসি করছিল সেইটাও ঘস শব্দ করে মুছে ফেললেন। সর্দি সাই করে সই করে ফেলে দিলেব জানলার বাহিরে৷ নিখুঁত শট৷ আমি বেয়ার গ্রিলস দেখিনি দেখেছি আজিজ ভাই৷ তাই সেই ছোটবেলা থেকে নার্ভ অনেক শক্ত৷

এরপর তিনি আবার হেসে আমার দিকে তাকালেন, ‘ভাল হল ব্রাদার, আমিও একা বের হয়েছি সঙ্গী নাই৷ এক সাথে ঘুরবো।’ নাই মামার চেয়ে আজিজ মামা ভাল৷ আর এই মামা আমারে ভাই বানাইয়া দিল৷ অদ্ভূত মানব জনম। বাস হেলে দুলে মোগড়পাড়া নামার পর উনাকে এড়াতে চাইলাম। কিন্তু এরপর উনি যা বললেন কানে তব্দা খেয়ে গেলাম। ‘ব্রাদার চল, চলতে চলতে শুনবো তোমার স্কুল পালানোর গল্প।’ চোরের মন হাজার হক পুলিশ পুলিশ৷ তাই চড়ে বসলাম বেবি স্কুটারে৷ তখন বেবি স্কুটার বিলুপ্ত হয়নি ঢাকার বাহিরে৷ বেবি ছুটছে আর আমি আমার স্কুল পালানোর পেক্ষাপট বর্ণনা করছি৷ সব কিছু শুনলেন। এরপর চলে গেলেন ঘোরের জগৎতে।

সেখান থেকে যখন ফিরলেন তখন গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘ব্রাদার দিস ইস গুড থিং৷ স্কুল পালানো ভাল। কিন্তু তোমার মা বাপ তো তোমারে পড়তে পাঠায়৷ আর আমার বাসাও তোমাদের স্কুলের আশেপাশে৷ আজকে যে কাজ করছো আর কইরো না৷ আমি তোমার খবর নিতে যামু সময় পাইলে৷ তোমাগো পিটি স্যার গরম কাশেম আমার বাড়িতে ভাড়া থাকে।’ শুনে জমে গেলাম। তবে আজিজ ভাইয়ের হাসিতে পেলাম নির্ভরতা৷ তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন, হাই আই এম আজিজ। এবার দুজন অসম বয়সী মানুষের ভ্রমণ যে শুরু হল।

মোগড়াপাড়া থেকে শুরু হল আমাদের যাত্রা। জীবন ও যৌবনের গল্প শুনে কান ঝালাপালা। আবার মাঝে মাঝে এডাল্ট কথাবার্তায় কান গরমও হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বার বার সুইট সিক্সটিনে এসব শিখতে হয় বলিয়া আমাকে গিলাচ্ছে অথচ জানেন না আমি ছোটবেলা থেকে জ্ঞান পিপাসু। প্রথমে চলে গেলাম পানাম নগর। তখন পানাম নগরে ছিল না কোন টিকেটের ব্যবস্থা।
পানাম নগরে কোন হারানো নগরী শুনায় তার নিখোঁজ কাব্য। ঈশা খাঁয়ের রাজধানি নিয়ে ততদিনে পড়ে ফেলেছি ইতিহাসের বইতে। ২০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পানাম নগর এখন টিকে আছে হারানো নগরের শেষ ধ্বংসস্তুপ হিসাবে। ওয়াল্ড মনুমেন্ট ফান্ডের তৈরি বিশ্বের ধ্বংস প্রাপ্ত ১০০ শহরের তালিকায় আছে পানাম নগরীর নাম।

পানাম নগরীর চর্তুদিকে পঙ্খিরাজ খাল একে বেকে গেছে। পঙ্খিরাজ খাল গিয়ে মিশেছে মেনি নদের সাথে, তবে সেখানে মেনি মাছ পাওয়া যায় কি না তার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। এই দুই মিশ্রণ গিয়ে মিসেছে মেঘনা নদীর সাথে। পুব দিকে শীতলক্ষা নদী পশ্চিমে মেঘনা। এই নদী পথেই তো একদা আসতো ঢাকাইয়া মসলিন, বিলাতি থান কাপড়। পালতোলা নৌকাগুলা কোথায় হারালো, একদা এখানেই তো ভিড়তো বণিকদের তরি।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠে পানাম নগরী। তবে নীল করের কড়াল গ্রাস ছাড়েনি এই নগরের বাসিন্দাদের, পোষাক জায়গা দখল করে নেয় নীল বিষ। নীল বাণিজ্যের জন্য জাকিয়ে বসে এখানের নীল কুঠি। পানাম পুলের কাছে দুলাল্পুর সড়কের পাশেই এই নীল কুঠির অবস্থান। এই নীল কুঠি শুরুতে মসলিন কাপড়ের ক্রয়কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হলেও পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক নীলের ব্যবসার কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলে।

পঙ্খিরাজ খালের ওপর একটি পুল পর্যটকদের দূর থেকে আর্কষণ করে। এই আমিনপুর থেকে দুলালপুর গ্রামে যাবার ব্যবস্থা সেই ১৭শ শতকেই গড়ে উঠেছিল। পুলের নিচ দিয়ে চলাচল করতো পণ্যবাহি নৌকাসহ, সাধারণ যাত্রী। এই নগরীর প্রবেশ পথে ছিল বিশাল গেট, যা সূর্যাস্থের সাথে সাথে বন্ধ করে দেওয়া হত। আজ কোথায় সেই গেট চারদিকে পুরানো স্থাপত্যের নির্দশণের মাঝে হারিয়ে গেছে কালের জৌলুস।
ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার শ্রুতি অনুসারে সুলতানি আমলে পানাম ছিল সোনারগাঁর রাজধানি। কিন্তু তার কথার তেমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে জেমস টেলরের মতে সোনারগার প্রাচীন শহর ছিল আজকের এই পানাম নগর। শহরের ঔপনিবেশিক আংগিকে তৈরি দোতকা এবং একতলা বাড়ি গুলো মূলত ঊনবিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে গড়ে উঠে। ১৮১৩ সালের নামফলক পাওয়া গেছে কোন প্রাচীন বাড়িতে। পানামে বাস ছিল মূলত বনেদী হিন্দু ব্যবসায়িদের। তাদের ব্যবসা ক্ষেত্র বিরাজ ছিল ঢাকা কলকাতা জুড়ে। তাদের পদধূলিতে মুখরিত ছিল হারিয়ে যাওয়া এ শহর।

১৬১১ সালে মোঘলদের পদচিহ্ন পরার পর এই নগরে গড়ে উঠে সড়ক ও সেতু। ছড়িয়ে পড়ে পানাম নগরের নাম। সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হয় রাজধানির সাথে পানামের। পানাম পুল (বিলুপ্ত), দুলালপুর পুল ও পানামনগর সেতুর অবস্থান ও তিনদিকের খাল-বেষ্টনীর ঘেরা এই নগরী ছিল তৎকালীন আমলে সোনারগাঁয়ের উপশহর। মসনদে ঈশা খাঁর ঘোড়ার খুড়ের শব্দের প্রতিধবনি হত এক কালে। মোঘলদের ত্রাস ঈশা খাঁ আর ঘোড়া চালিয়ে আসবেন না, তবে খোওয়াবি পোলাওয়ের ঘোড়া চালাচ্ছে আজিজ ভাই।
আমার পুরানো ভ্রমণ গল্পগুলো পড়তে চাইলে নিচের লিংকে চলে যান:
https://www.vromonguru.com/author/ashik/
আমার গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ পড়তে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন আমার ফেসবুক পেজ থেকে:
https://www.facebook.com/sarwar.ashik786
এর বাহিরেও আমাদের নিজস্ব ভ্রমণ গ্রুপ শেকড় সন্ধানীর মাধ্যমে নিয়মিত এ রকম বাংলার পথে ভ্রমণের আয়োজন করা হয়। ইচ্ছা থাকলে পাঠক আপনিও হতে পারেন আমাদের পরবর্তী ভ্রমণের সঙ্গী। আমাদের সাথে যোগাযোগের বিস্তারিত নিচে দেয়া হলো।
Roots Finder – শেকড় গ্রুপের সাথে থাকুন:
https://www.facebook.com/groups/459880764416865/
Roots Finder – শেকড় পেজ লিঙ্ক:
https://www.facebook.com/rootsfinder.bd/
শেকড় সন্ধানী দলের এডমিনদের নাম্বার:
ঈসমাইল হোসেন – ০১৭৫৬১৭১৫৭০
আশিক সারওয়ার – ০১৮৬৬৬৬৩৪২৩
শরীফ জামান – ০১৫৩৫৪৫৩৯৭৭
ঘুরেন দেশের পথে, খুঁজে ফিরুন নিজের শেকড়।