তখনকার পানামে ছিল না এত নিরাপত্তা। তাই আজিজ ভাইয়ের ঘর বাড়ির মতই ছিল পানাম নগর। এক কোণার বিল্ডিং নিয়ে গিয়ে তিনি ছলটু ধরালেন। গাজার কটু গন্ধের সাথে পরিচয় আগে কোন দিন ছিল না বিধায় বুঝতে পারলাম না উনি কি করছেন। শুধু বুঝলাম এইটা হয়তো অন্য টাইপের সিগারেট। গুরুজনের সামনে টানায় বিব্রত আর উনি আমায় অফার করলেন না বিধায় সে যাত্রায় এই মহাজাগতিক জগতের ডোরওয়ে খুলে দেওয়া বস্তুর সাথে পরিচিত হতে পারলাম না। না হয় তো কাণ্ড হয়ে যেত।

এরপর শুরু করলেন উনার বাণি। ‘ইউ নো ব্রাদার তুমি আজকে আমার অতিথি, আজকে তোমায় ঘুরাবো আমার রাজ্য। আমার এক পাশে বব মার্লে গান গায়, এক পাশে লালন সাই ধরে একতারা, দেখো দূরে জিম মরিসনকে গিটারের মৃদু তালে গাইছে রাইডার অফ দ্য স্ট্রম।’ আজিজ ভাই আমি হাঁটছি প্রাচীনের মাঝে। দুই অদ্ভূত যাযাবর। শুনতে পারলাম তার জীবনের জ্যোৎস্নার চলে যাওয়ার ইতিহাস। সে না হয় উহ্য থাক। এমনেতে কলেবর শুধু বেড়ে যাচ্ছে। আজ স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে না বললেই নয় এখন উইকিপিডিয়া কত সহজে আমাদের ইতিহাস খুঁজে বের করে দেয়। সেইটা কি ১৫ বছর আগে সম্ভব ছিল।

পানামে টিকে থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে ৫২টি বর্তমানে উল্লেখযোগ্য। সড়কের উত্তরে ৩১টি আর দক্ষিণে ২১টি বাড়ি এখন দাঁড়িয়ে আছে আমাদের গল্প শুনাতে। সে এক ঐতিহ্যের গল্প, আদি ইতিহাসের গল্প। বাড়ি গুলো অধিকাংশই আয়তাকার, উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত, উচ্চতা একতলা থেকে তিনতলা। ঔপনিবেশিক, মোঘল, গ্রিক এবং গান্ধারা স্থাপত্য শৈলীর এক অপূর্ব মিশ্রণের সাথে মালাইয়ের প্রলেপ দিয়েছে স্থানীয় কারিগরদের শৈল্পিক ছোয়া।
প্রতিটি বাড়ি যেন আজ কবি, শুনাতে চায় কোন পদ্য। কহেন কবি কারুকাজ, রঙের ব্যবহার, এবং নির্মাণকৌশলের শৈল্পিক কাব্যকথা। ইটের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই-লোহার তৈরি ব্র্যাকেট, ভেন্টিলেটর আর জানালার গ্রিল। বাড়িগুলোর নকশা ও কাস্ট আয়রনের নিখুঁত কাজ দেখে চুমু দিয়ে যেতে ইচ্ছে করবে শিল্পির হাতে। কি বলে ওদের কারিগর ওরা তো শিল্পের যাযাবর। ইউরোপের মৃদু ছোয়া দিয়ে কাস্ট আয়রনগুলো আরও সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এর সাথে আছে সিরামিক টাইলসের আচ্ছাদন। প্রতিটি বাড়ি অন্দরমহল ও বহ্নি মহল নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বেশির ভাগ বাড়ির চারদিকে উন্মুক্ত উঠান।

শিল্পের কল্পনাকে হারিয়ে যায় পানামের নিখুত পরিকল্পনা দেখে, পানি সরবরাহের জন্য দু পাশে ২টি খাল ও ৫ টি পুকুর সহ প্রায় প্রতিটি বাড়িতে লক্ষ্য করা যায় কুয়া ও কুপ। প্রতিটি বাড়ি পরস্পর থেকে সম্মানজনক দূরত্বে অবস্থিত। জল যেন জমতে না পারে রাস্তা খালের দিকে ঢালু রাখা ছিল। আর যাতায়াতের জন্য এক মাত্র রাস্তা নগরীর মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে এপাশ-ওপাশ। পানামের ভিতরে আবাসিক ভবন ছাড়াও আছে মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, মঠ, গোসলখানা, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, খাজাঞ্চিখানা, দরবার কক্ষ, গুপ্ত পথ, বিচারালয়, পুরনো জাদুঘর।
সময়ের পরিভ্রমণে ঘুরছিলাম যেন এতক্ষণ। আজিজ ভাইয়ের সাথে পানাম নগরের সফর শেষ হলেও উনার আধ্যাত্মিক ভাবালুতা শেষ হচ্ছে না। এবার পানাম থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত গোয়ালদি মসজিদ দেখাতে আবার হাঁটা শুরু হল আমাদের। ছলটুর নেশায় বুদ আজিজ ভাই। এই এলাকা তার নখ দর্পণে যেন বলতে চাচ্ছেন আমি যে এক রাজা এই অঞ্চলের। আর আমি হচ্ছি তার সাইড কিক। ওই হয় না রাজাদের ফুট ফরমেশ কাজ করে দেবার লোক। দেখতে দেখতে চলে এলাম গোয়ালদি মসজিদ।

সোনারগাঁ অঞ্চলের একমাত্র সুলতানি আমলে নিদর্শন বলা যায় গোয়ালদি মসজিদ। এরপর মেঘনা নদী হারালো কত গতি পথ, কত দেখলো প্রকৃতির ধ্বংসযঞ্জ। সোনারগায়ের অনেক প্রাচীন নির্দশন হারিয়ে গেছে ভূ-গর্ভে। সেই গোয়ালদি গ্রামের বাশ ঝাড় আর আম, কাঠাল গাছের জঙ্গলের আড়ালে দৈবক্রমে টিকে গেছে এই এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি। এই মসজিদে থেকে একটি শিলালিপি আবিষ্কার করা হয়। সেই শিলালিপি থেকে তথ্যে পাওয়া যায় সৈয়দ আশরাফ আল হোসাইনির পুত্র সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের শাসনামলে ৯২৫ হিজরির ১৫ শাবান/১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে মসজিদ নির্মাণ করেন মোল্লা হিজাবর আকবর খান।

শিলালিপিটির ছাপচিত্র গ্রহণ করে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলে প্রেরণ করেন আলেকজান্ডার কানিংহাম। ১৮৭৩ সালে আরবি ভাষায় লেখা এই শিলালিপির অনুবাদসহ সম্পাদনা করেন হেনরী ফার্ডিনাল্ড ব্লকম্যান। প্রাক-মুগল যুগের এই অপূর্ব নির্দশন এই এলাকার মধ্যে সর্বপ্রাচীন। প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ যখন এই মসজিদকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করলে তখন এর ধ্বংস প্রায় অবস্থা। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মত পুনরায় যেন জন্ম নেয় গোয়ালদি মসজিদ ১৯৭৫ সালে। এরপর থেকে অনেক সংস্কার করা হয়েছে এই মসজিদের। এর পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে যথাক্রমে তিনটি ও একটি খিলানাকৃতির প্রবেশ পথ ছিল। পরবর্তিতে তা ইট দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়। পেন্ডেটিভের সাহায্যে নির্মিত গম্বুজটি ভিত্তি চারকোণের চারটি স্কুইঞ্চ খিলানের উপর স্থাপিত। মসজিদটির ভেতরের ছাদের ভার রক্ষা করার জন্য কালো পাথরের কিছু অলংকৃত স্তম্ভও রয়েছে।
মসজিদের তিনটি মিহরাব পরিলক্ষিত করা যায়। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত প্রশস্ততর। কালো পাথরে খোদাইকৃত ফুল ও আরব্য নকশার স্মিফোনি অবশ্যই আকৃষ্ট করবে ঐতিহ্য অন্বেষণকারীর। পাশের দুইটি মিহরাবে পোড়ামাটির অলংকৃত ফুল ও জ্যামিতিক নকশা কারিগরের মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয় ও বটে। পাথরের তৈরি কেন্দ্রীয় মিহরাব খানি একটি খিলানকৃত প্যানেলের মধ্যে অবস্থিত। এর উপরিভাগের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্যমুখীর নকশা। মসজিদের বাহিরের দিকে চারকোণে দেখা যায় ব্যান্ডযুক্ত চারটি গোলাকার পার্শ্ববুরুজ, যেগুলো উঠে গেছে মসজিদের বাকানো কার্নিশ পর্যন্ত।

অদ্ভুত মানব জনম, অদ্ভুত আজিজ ভাই। তার মনে যেন কোন শান্ত নদীর বাস, সেখানে কি ছিল অসীম প্রভুর নিবাস। মানুষ কতটা দুঃখ নিয়ে মাদকাসক্ত হয়, সেইটা কোন দিন সমাজ দেখবে না। পাপ কে নয় পাপীকে ঘৃণা করাই সমাজের কাজ। একটা মানুষের সুস্থ জীবনে ফেরার সব রাস্তা সমাজই বন্ধ করে দেয়। আজকে প্রিয়ার হাত যদি আজিজ ভাইয়ের হাতে থাকতো গল্পটা হয়তো অন্য রকম হত। উদাসি চোখে কি ছিল এক রাশ অভিযোগ, জগৎপিতার সাথে কি মসজিদের দেয়াল ছুয়ে যেন হচ্ছে তার গোপন কথা।

গোয়ালদি মসজিদ দেখা শেষে এবার সামনে আগানোর পালা। বিকাল হয়ে গেছে। সূর্য তার রুদ্র রূপ লুকিয়ে ফেলেছে অনেক আগে। ঘরে ফেরার বার্তা শুনায় নিড়ে ফিরে আসা পাখি, আমার ও তো স্কুলের ঘণ্টি পড়ে গেছে। আজিজ ভাইও যেন ব্যাপারটা বুঝে গেল। আজিজ ভাই মুচকি হেসে গাইতে লাগলেন, ‘অনুরাগ নইলে কি সাধন হয়, সে তো মুখের কথা নয়।’
বিঃদ্রঃ ছবিগুলো ২০১৫ সালের তোলা। গল্পের খাতিরে যোগ করা।
আমার পুরানো ভ্রমণ গল্পগুলো পড়তে চাইলে নিচের লিংকে চলে যান:
https://www.vromonguru.com/author/ashik/
আমার গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ পড়তে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন আমার ফেসবুক পেজ থেকে:
https://www.facebook.com/sarwar.ashik786
এর বাহিরেও আমাদের নিজস্ব ভ্রমণ গ্রুপ শেকড় সন্ধানীর মাধ্যমে নিয়মিত এ রকম বাংলার পথে ভ্রমণের আয়োজন করা হয়। ইচ্ছা থাকলে পাঠক আপনিও হতে পারেন আমাদের পরবর্তী ভ্রমণের সঙ্গী। আমাদের সাথে যোগাযোগের বিস্তারিত নিচে দেয়া হলো।
Roots Finder – শেকড় গ্রুপের সাথে থাকুন:
https://www.facebook.com/groups/459880764416865/
Roots Finder – শেকড় পেজ লিঙ্ক:
https://www.facebook.com/rootsfinder.bd/
শেকড় সন্ধানী দলের এডমিনদের নাম্বার:
ঈসমাইল হোসেন – ০১৭৫৬১৭১৫৭০
আশিক সারওয়ার – ০১৮৬৬৬৬৩৪২৩
শরীফ জামান – ০১৫৩৫৪৫৩৯৭৭
ঘুরেন দেশের পথে, খুঁজে ফিরুন নিজের শেকড়।