সন্ধ্যার আগেই তৈয়ব ভাই আমাদের তাঁবুগুলো পিচ করে দিলেন। আমাদের ক্যাম্পসাইট ছিল ট্রি অ্যাক্টিভিটির জায়গাতেই। সন্ধ্যায় সবাই মিলে সেই অফিস ঘরটায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। ফখরুল ভাই, ফাসকা, সেতু দা দাবা খেলা শুরু করলেন। দাবার বোর্ড, গুটি নিয়ে আসছিলেন ওনারা বাসা থেকে। সেইরকম খেলা হচ্ছিলো। এর মাঝে কাদের যেন মুড়ি মাখা খাওয়ার শখ জাগলো।



তৈয়ব ভাই আমাদের চানাচুর, মুড়ি, টমেটো, শসা, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, লবণ, সরিষার তেল সব দিয়ে গেলেন। সাথে ছোট ছোট পিঁয়াজু। চানাচুর আর পিঁয়াজু দেখে সবাই এমনিই খাওয়া শুরু করলো। সালমা আপা আবার রোমান ভাইকে বললেন, ‘ভাই কোক খাওয়াও।’ রোমান ভাই কথা না বললেও, কাজে খুবই চটপট। বলতে না বলতেই দুটো কোক নিয়ে হাজির হলেন। তারপর আমাদের জ্বালায়ই কিনা কে জানে, বাইরে চলে গেলেন। বেচারা সামনে থাকলেই আমরা ওনাকে কথা বলার জন্য জোর করি। আমি ভাবছিলাম, কথা বলতে না পারলে আমি ডাঙায় তোলা মাছের মতো খাবি খেতাম। আর উনি সারাদিনে হাতে গুনে দশটা কথাও বলেন না! মানুষ কতো বৈচিত্র্যময়! ফখরুল ভাই মোগলাই আনিয়ে দিলেন। সেটা ফাসকা আর তেহজীব মিলে শেষ করে ফেললো। সেবা আপু আর সাব্বির ভাই কাটাকুটি করে ফেললেন। সেতুদা এসে মুড়ি মাখালেন। ভালো একটা ‘মুড়ি আড্ডা’ হলো। আমাদের খাওয়ার তোড়জোড় দেখে কোত্থেকে একটা কুকুরও হাজির হয়েছিল!


কিছুক্ষণ পর আমি, সাব্বির ভাই, সেবা আপু হাঁটতে বের হলাম। আশীষদা বেশিদূর যেতে নিষেধ করলেন। অন্ধকার রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন হাঁটাও ভালো লাগে। সাথে যদি আকাশে থাকে তারার মেলা, তাহলে আর কি চাই! সাব্বির ভাই দেখি মোবাইলটা নিয়ে খুব কসরত করছেন তারাভরা আকাশের ছবি তোলার জন্য। এর মাঝে মুশতাক আর শরীফ ভাইও চলে আসলেন। সাব্বির ভাই পরীক্ষামূলকভাবে মুশতাকের একটা ছবি তুললেন। কিন্তু মনমতো হলো না। একে একে আমরা সবাই মডেল হয়ে গেলাম। তারপর শুরু হলো এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে দূর্লভ ফটোশুট। খালি চোখে সবাই দেখবে আকাশ ভরা তারার মাঝে পিচ ঢালা রাস্তায় একটা মানুষ বসে আছে। কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাথার উপরের সেই আকাশটা, নিচে বসে থাকা মানুষটা ফ্রেমে আনতে যে বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করা হয়েছে, সেটা দেখেই আমি চমৎকৃত হচ্ছিলাম!


একসময় ডাক পড়লো। আশীষদা বারবিকিউ করবেন আমাদের জন্য। আমরা ক্যাম্পসাইটে চলে গেলাম। একপাশে বারবিকিউয়ের সব সরঞ্জাম রাখা আছে। আশীষদা কাজ শুরু করলেন। রাতের খাবারের মেন্যু হচ্ছে সবজি খিচুড়ি আর বারবিকিউ চিকেন। একদিকে বারবিকিউ হচ্ছে, আরেকদিকে তেহজীব গান শোনাচ্ছে। পাঁচটা তাঁবু, মাঝে আলাদীনের প্রদীপের মতো একটা কুপি জ্বলছে। মোহনীয় পরিবেশ চারদিকে! সেদিন Ctg Biker Club নামের একটা গ্রুপ থেকে বিশাল দল এসেছিল সেখানে ক্যাম্পিং করতে। ওদের ক্যাম্পসাইটও পাশেই ছিল। হঠাৎ এক ভাইয়া এসে মুশতাককে বলে গেলেন, ‘ভাইয়া, আমাদের একজনের জন্মদিন। কেক কাটা হবে। বাবুকে নিয়ে আসবেন।’ আমরা রাতের খাওয়া শেষ করে গেলাম সেখানে। বাইকের চোখ ধাঁধানো আলোতে হৈ চৈ করে কেক কাটলেন সবাই। তেহজীব সেখানেও যেয়ে গান শুনিয়ে আসলো।


রাত বাড়ছিল। তেহজীবকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। এখনো আমাকে জড়িয়ে না ধরে ঘুমাতে পারে না। বের হয়ে এলাম তাঁবু থেকে। আকাশটা তখন আধখাওয়া চাঁদের আলোতে ঝলসে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরের আকাশ খুব পরিষ্কার থাকে। ঢাকায় তো পূর্ণ চন্দ্র পূর্ণিমাতেও এতো আলো দেখা যায় না। আমরা গল্প করছিলাম, গান শুনছিলাম। সাব্বির ভাই আবার কিছু ছবি তুললেন আমাদের। তাঁবু, চাঁদ, কুপির আলো… নানারকম থিমের ছবি। একটু পর সেবা আপু উঠে গেলেন। রয়ে গেলাম আমি, মুশতাক, সাব্বির ভাই, সেতু দা আর রোমান ভাই। আমি পাশেই ছিলাম বসে। হঠাৎই শুনতে পেলাম সাব্বির ভাইয়ের মোবাইলে যে গান বাজছে, সেটা রোমান ভাই খুব নিচু স্বরে, কিন্তু পরিষ্কার উচ্চারণে আবৃত্তির মতো আওড়াচ্ছেন। পরে অনুরোধ করা হলে উনি দুটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। যার একটা শুনে আমার চোখে পানি চলে আসছিল! একসময় মোবাইলের গান বন্ধ করে সেতুদা নিজেই গান ধরলেন। কণ্ঠে দরদ আছে সেতুদার। ভালো লাগছিল। আস্তে আস্তে মুশতাক, আমি, সাব্বির ভাইও তাল মিলাচ্ছিলাম। রোমান ভাই গানের লিরিক্স খুঁজে দিচ্ছিলেন, আমরা গাইছিলাম। এভাবে গানে গানে সময় কিভাবে কেটে যাচ্ছিলো জানি না। হঠাৎ করেই তেহজীব কেঁদে উঠলো। আমি ঢুকে পড়লাম তাঁবুর ভেতর। তারপর আর আসর জমলো না। সবাই শুয়ে পড়লো।


পরদিন খুব সকালে উঠতে হবে৷ আমরা জঙ্গলের ভেতর যে ট্রেইলটা আছে, সেটাতে যাবো। আমরা তিনজন, সাব্বির ভাই, রোমান ভাই রওনা হলাম। পথে পুকুরে দেখি সাদা শাপলা ফুটে আছে। মুশতাক মেয়ের জন্যে একটা শাপলা তুলে আনলো। সেই শাপলা হাতে নিয়েই ট্র্যাকিং করছিল সে।

এই ট্রেইলটা একেবারেই জঙ্গলাকীর্ণ। কিছু জায়গায় তো সাব্বির ভাই হাতে থাকা ছুরি দিয়ে ঝোপঝাড় কেটে পথ তৈরি করছিলেন। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা হাঁটার পর একটা সমতল জায়গায় দাঁড়ালাম। এরপর সেখান থেকে নিচে নামতে হবে। এর মধ্যে আমাদের উপর জোঁকের আক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাও আবার সব টাইগার জোঁক! তেহজীবের পায়ে একটা জোঁক মাত্র উঠছিল আর ও জোঁকের ডিগবাজি দেখে এমন এক চিৎকার দিলো! তার শখের শাপলা ফুলটাও পড়ে গেল। আমরা ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। অন্য পথে মিনিট পঁচিশ লাগলো ফিরতে। জোঁকের ভয়ে আমরা হাঁটছিলামও দ্রুত।




হাজারিখিলের ভেতরে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ একটা সাইক্লিং ট্রেইল আছে। কালাপানি ঝর্ণায় যেতে যে ঝিরি থেকে ডানে যেতে হয়, এই ট্রেইলে সেই ঝিরি থেকে সোজা চলে যাওয়া লাগবে। আমরা মোটামুটি দুই কিলোর মতো হেঁটেছিলাম ট্রেইলের উঁচু নিচু পথে। এইসব জায়গায় সাধারণ সাইকেল চালানো যাবে না। এখানে মাউন্টেন বাইক লাগবে, যা তৈরি করা হয় পাহাড়ি অসমতল পথে চলার উপযোগী করে। সকালে পেটে দানাপানি না দিয়েই বের হয়েছিলাম। ক্ষুধায় আর হঠাৎ রোদ উঠে যাওয়া গরমে শরীরে এক রাশ ক্লান্তি ভর করছিল। ফিরতি পথে হাঁটা ধরলাম আবার।




ফেরার পথে সেই ঝিরির স্বচ্ছ পানিতে কিছুক্ষণের জন্য গা এলিয়ে দিলাম।। মুহূর্তেই সব ক্লান্তি, ক্ষুধা উবে গেল! আর উঠতে মন চায় না। প্রায় আধা ঘণ্টা ল্যাটানি শেষে উঠলাম। দোকানে যেয়ে চা খেলাম। চা খুব ভালো ছিল। চা খেতে খেতে দেখলাম দোকানের পাশের ফুল গাছগুলোর কাছে দুইটা সুন্দর বাচ্চা সাপ। কাছে যাওয়ার আগেই চোখের পলকে কোথায় চলে গেল!


এদিকে তাঁবু থেকে আমাদের ব্যাগগুলো নিতে হবে। সেদিকে রওনা হলাম। আমরা আগে আগে যাচ্ছিলাম। তেহজীব ছিল একটু পিছনে। হঠাৎ একটা লোক চিৎকার করে উঠলো ‘সাপ! সাপ!’ বলে। আমি চমকে ফিরে দেখি বাদামী রঙা একটা সাপ, মাথার দিকটা সবুজ-কমলার মিশেল, এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। সাপের এই পাশে আমরা, অন্যপাশে তেহজীবের হাত ধরে আছে লোকটা। আমরা সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে আছি সাপের দিকে। সাপও মনে হয় ভাবছে কি করবে। তারপর উল্টো ঘুরে আবার চা বাগানের ভেতর ঢুকে গেল। ভাগ্যিস লোকটা দেখেছিল!
আমরা হাতমুখ ধুয়ে একবারে তৈরি হয়ে গেলাম। সবজি খিচুড়ি আর ডিমের ঝোল দিয়ে সকালের নাস্তা করে নিলাম। তারপর সবার কাছে বিদায় নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হলাম। আমরা বারৈয়াঢালা হয়ে ফিরেছিলাম। পথে একটা রাবার বাগান ছিল। সেখানে নেমে চা খেলাম। সেদিন দুপুরে খাবার পর রওনা হয়ে রাত দশটা বেজে গিয়েছিল বাসায় ফিরতে। কুমিল্লায় প্রায় ঘণ্টা তিনেক আটকে ছিলাম।

সব মিলে চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে সেই রাতে সাব্বির ভাই আর আমার একটা ডুয়েট করার কথা ছিল। সেটা অবশ্য আর হয়নি! ২০১৪ সাল থেকে সহ-ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে এই অভয়ারণ্য। দায়িত্বে আছে হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য সহ-ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল ও কমিটি। ক্যাম্পিংয়ের জন্যে যা যা লাগে সবকিছু ওরাই ব্যবস্থা করে দেয়। কয়জন যাবেন, কি খাবেন বলে দিলে ওরা তাঁবু দিবে, রান্নাও করে দিবে। চাইলে নিজেরাও রান্না করতে পারবেন। এক তাঁবুতে দুইজন থাকতে পারবেন। ক্যাম্পিং করতে না চাইলে এমনি ঘুরেও আসতে পারেন চমৎকার এই অভয়ারণ্যে।
আমরা গিয়েছিলাম এক্সট্রিম ট্রেকার অফ বাংলাদেশ (ইটিবি) এর সাথে। তাদের সাথে যোগাযোগের বিস্তারিত নীচে দেয়া হলো। https://www.facebook.com/groups/extremeTbangladesh/?refid=12
সেতু দাস: ০১৮৮৩৬৯৭৭২৮
মিরাজুল ইসলাম সাব্বির: ০১৭১০২৮৯৯৮৪/ ০১৮৬১৯৮০০৩৮
ভিডিওতে আমাদের হাজারিখিল ট্যুর দেখতে ক্লিক করুন:
https://youtu.be/BKu0uvXUZQU
আমার পুরানো ভ্রমণ কাহিনীগুলো পড়তে চাইলে ক্লিক করতে পারেন এই লিংকে: https://www.vromonguru.com/author/azmi
বিঃদ্রঃ ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলবেন। নিজের দেশ পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদের দায়িত্ব।
ফিচার ছবি: মিরাজুল ইসলাম সাব্বির ভাই
ভিডিও কৃতজ্ঞতা: মিরাজুল ইসলাম সাব্বির ভাই
পুরোটা পরলাম পুরো ট্যুরেই তুলে ধরলেন লেখার মধ্য দিয়ে ধন্যবাদআপু।
সাব্বির আপনাদের ভালোবাসায়, বেচে থাকবে দোয়া করবেন।
ধন্যবাদ সাব্বির ভাই🙂