বর্ষাকালে বাংলাদেশের যে অপূর্ব রূপ দেখা যায় তা বছরের অন্য সময় দেখা যায়না। নদী-খাল-বিল-হাওড়-ঝর্ণা মিলে অনন্য সাজে দেখা দেয়া আমাদের সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ। প্রতিবছর তাই আমার মতো অনেকেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে কখন আসবে বর্ষাকাল। ভরা বর্ষায় কিছু জায়গায় না গেলেই নয়, কারণ বছরের অন্য সময় সে জায়গায় গেলে হয়তো একটুও ভালো লাগবেনা। চলুন দেখি বাংলাদেশে বর্ষার সেরা কিছু গন্তব্য:
টাংগুয়ার হাওড়: প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার নিয়ে গঠিত টাংগুয়ার হাওড় বাংলাদেশের ২য় রামসার সাইট। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পর্বত বেয়ে নামা ত্রিশটিরও বেশি ঝর্ণার পানিতে আশীর্বাদপুষ্ট এ হাওড়টির অবস্থান বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমের জেলা সুনামগঞ্জে। মিঠাপানির নয়নাভিরাম এ জলাভূমিতে নৌকায় নিয়ে কয়েকদিন কাটানো সারাজীবন মনে রাখার মতো একটি স্মৃতি হবে। জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মধ্যে বিস্তৃত এ হাওড়টি।

বছরের অন্য সময় পানি কম থাকলেও বর্ষায় প্রায় ১০,০০০ একর এলাকা জুড়ে পানি থাকে এ হাওড়ে। দূরের মেঘালয়ের পর্বতগুলোর পটভূমিতে নীল পানির এ হাওড়ে জীবনে অন্তত একবার হলেও রাতে থাকা উচিত। আর সেদিন যদি পূর্ণিমা রাত হয়, তবে তো কথায় নেই। হিজল, করচ, বরুণ, নলখাগড়া, হেলেঞ্চা, শাপলা, শালুক সহ স্বাদুপানির অনেক রকম গাছগাছালি ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার পাখি আর ২০০ প্রজাতির মাছ নিয়ে জীববৈচিত্রে ভরপুর এ হাওড়ের প্রতিবেশ। হাওড়ের বৃষ্টিও দেখার মতো একটা বিষয় বটে, তাই বর্ষায় পছন্দের গন্তব্যের শীর্ষে আছে টাংগুয়ার হাওড়।

কেওক্রাডং: বর্ষায় পাহাড়ের সৌন্দর্যই অন্যরকম। আর সে পাহাড় যদি হয় বান্দরবানের, তাহলেতো কোন কথাই নেই। ভরা বর্ষায় চলে যেতে পারেন বান্দরবানের রুমা উপজেলায় দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ পর্বত কেওক্রাডং। বগা লেক থেকে ট্রেকিং করে এ পর্বতে যাওয়ার সময় চোখে পড়বে বর্ষায় ফুলে ফেঁপে ওঠা চিংড়ি ঝর্ণা। এ সময়টা হঠাৎ হঠাৎ মেঘে ঢেকে ফেলে পাহাড়ের চূড়াগুলো। আর চারদিকটায় সবুজের সমারহ, প্রকৃতি ফিরে পায় তার সর্বোচ্চ সৌন্দর্য।
ভাসমান পেয়ারা বাজার: পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলা ও ঝালকাঠির সদর উপজেলার অন্তত ২৪ হাজার একর এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে পেয়ারার বাগান। দেশে উৎপাদিত পেয়ারার ৮০ শতাংশ উৎপাদন হয় এ জায়গাগুলোতে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যখন গাছ থেকে পাড়া পেয়ার বোঝাই করে নৌকা নিয়ে হাটগুলোতে বিক্রি করতে আসে দেখার মতো একটা দৃশ্যের অবতারণা হয়। আর তা দেখতেই ছুটে যান পর্যটকরা।

ভিমরুলি বাজার ও আটঘর বাজার এখানকার সবচেয়ে বড় বাজার। সন্ধ্যা নদী থেকে খাল ধরে আটঘর বা ভিমরুলি বাজার আসার সময় পথে পথে দেখতে পারবেন অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতি। আমড়া আর পেয়ারার বাগান পার হয়ে এক সময় দেখা মিলবে পেয়ারা ভর্তি নৌকা নিয়ে ছুটে চলা চাষীদের। চাইলে এসব জায়গায় পছন্দমতো পেয়ারাও কিনে নিতে পারবেন।

অষ্টগ্রাম-মিঠামইন: বর্তমান বাংলাদেশের জনপ্রিয় বর্ষার গন্তব্য অষ্ট্রগ্রাম-মিঠামইন। বিশেষ করে অল ওয়েদার রোড হবার পরই বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের এই দুই উপজেলা। তবে শুধু রাস্তা নয় মিঠামইন-অষ্টগ্রামের হাওড় দেশের অন্যতমে সুন্দর হাওড়। ঝুম বৃষ্টিতে এ হাওড়ে ঘুরতে পারেন নৌকা নিয়ে। আর রোদেলা দিনে নীল আকাশে পটভূমিতে এ হাওড় আরো অনেক বেশি সুন্দর। এছাড়া কাছাকাছি নিকলি হাওড়ও ঘুরে আসতে পারেন।

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট: সিলেট শহরের খুব কাছে গোয়াইনঘাট উপজেলায় স্বাদু পানির বন রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টের অবস্থান। বর্ষায় এ বনের বেশিরভাগ অংশ পানিতে ডুবে যেয়ে অবতারণা হয় এক নৈসর্গিক দৃশ্যের। আর সেই বনের মধ্যে ইঞ্চিনবিহীন নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। হিজল, করচা, বরুণ, বেত, বট গাছ সহ অসংখ্য গাছের পাশপাশি দেখা মিলবে মাছরাঙ্গা, বক, টিয়া, ঘুঘু, বাজপাখি সহ অনেক ধরণের পাখির। এছাড়া গুইসাপ ও সবুজ বোড়া সাপের দেখা মিলবে এ বনে, তবে মানুষের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকে তারা।

হামহাম ঝর্ণা: ভরা বর্ষায় চলে যেতে পারেন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রাজাকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের মধ্যে লুকায়িত বাংলাদেশে অন্যতম সুন্দর ঝর্ণা হামহাম। এ ঝর্ণায় যেতে হলে প্রথমে শ্রীমঙ্গল থেকে চা বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আসতে হবে কলাবাগান পাড়ায়। সেখান থেকে মোটামুটি ২ ঘন্টা ট্রেকিং করে পৌছাতে পারবেন এ ঝর্ণায়। এ ট্রেকিংয়ের পথ বর্ষায় যতটা সুন্দর ততটাই কঠিন বলতে হবে। তবে একবার হামহামের পাদদেশে আসলে সব কষ্ট ভুলে যাবেন এর সৌন্দর্য দেখে।

সাজেক: বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের পছন্দের গন্তব্যের বলতে গেলে শীর্ষেই আছে সাজেক। রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত সাজেক ভুপৃষ্ট থেকে ১,৮০০ ফিট উঁচুতে অবস্থিত অন্যতম সুন্দর প্রকৃতি পর্যটন স্থান। বর্ষার শুরু থেকেই এখানে মেঘেদের যেনো আসর বসে। তাই বর্ষার গন্তব্য হিসেবে বেছে নিতে পারেন সাজেককে। প্রকৃতি এখানে ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদল করে। কোন কোন সময় মেঘ এসে ঢেকে দেয় পুরো রাস্তা।

খৈয়াছড়া ঝর্ণা: চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুন্ড রেঞ্জ জুড়ে গঠিত বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যান। ৩,০০০ হেক্টরের বেশি বনাঞ্চল ও পাহাড় নিয়ে গঠিত এ বনে লুকিয়ে আছে অসংখ্য ছোট-বড় ঝর্ণা। তার মধ্যে আছে সবচেয়ে সুন্দর ঝর্ণা নি:সন্দেহে খৈয়াছড়া ঝর্ণা। এ ঝর্ণার মোট ৯ টি ধাপ আছে, এছাড়াও বেশ অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ রয়েছে। খৈয়াছড়া ঝর্ণায় যেতে হলে কয়েক কিলোমিটার ট্রেকিং করতে হয়। সবার পক্ষে অবশ্য সবগুলো ধাপে উঠা সম্ভব হয়না।

বিছনাকান্দি: সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী গ্রামে অবস্থান বিছনাকান্দির। মেঘালয় থেকে বেয়ে ঝর্ণার পানিতে নৈসর্গিক দৃশ্য তৈরী করে বর্ষার বিছনাকন্দিতে। সিলেট শহর থেকে সিএনজি নিয়ে প্রথমে আসতে হয় হাদার পার, সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করে ঘুরে আসতে পারবেন বিছনাকান্দি। শুধু পাহাড়ি জলের নদী, পাথর নয়, পাহাড়ের পটভূমিতে সবুজ বিছনাকান্দির গ্রামের দৃশ্যও নয়নাভিরাম। সুযোগ থাকলে ঘুরে আসতে পারেন পান্থুমাইও।
এ তালিকার বাইরে আপনার পছন্দের গন্তব্য থাকলে আমাদের জানান, আমরা সেটা নিয়েও লিখবো।
ফিচার ছবি: Noor A Alam
ঢাকার কাছেই শ্রীনগর, মুন্সিগঞ্জের আড়িয়াল বিল। ডে ট্রিপের জন্য বেস্ট বর্ষাকালে।
ঢাকার আশেপাশে নিয়ে আলাদা একটা লিখবো। আড়িয়াল বিলে পানি আসলে বইলো, সাইক্লিং ট্রিপ দিবো