কাউনিয়া – সাতমাথা – রংপুর – টার্মিনাল – রাজারামপুর বোর্ডঘর বাজার (বদরগঞ্জ)
৪৮.৪৩ কিলোমিটার
গত দুইদিনের মতো আজকে অবশ্য এলার্মের আগে উঠিনি। এলার্ম কখন বাজছে, নাকি বাজেনি সেটাও মনে করতে পারছিনা। আজকে অবশ্য উঠার তেমন ইচ্ছেও ছিলো না। গতকাল ঘুমাতে যাওয়ার সময়ই বুঝে গিয়েছিলাম আজকে অন্তত সকাল সকাল বের হওয়া হবেনা। এখানে গতকাল সারাদিনের টানা বৃষ্টির পর, সারারাত ধরেও বৃষ্টি হয়েছে। সকাল বেলা যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখনও বৃষ্টি থামার কোনো চিহ্নমাত্র দেখলাম না।
সকালের সেশনে বের হওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে, মোবাইল হাতে নিলাম। কতক্ষণ ফেসবুকে থেকে এরপর স্মার্ট ওয়াচ মোবাইল অ্যাপে কানেক্ট করে ঘুমের ডাটা দেখলাম। গতরাতের ঘুম নিয়ে একটু বলি, ঘুমিয়েছি টানা ৭ঘণ্টা যা গত কয়েক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত এক সপ্তাহের থেকে গড়ে প্রায় ৪০ মিনিট আগে ঘুমাতে গিয়েছি এবং ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট পরে ঘুম থেকে উঠেছি। ঘুম ভালো হয়েছে এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

যাইহোক, ৮টার দিকে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে ছাতা নিয়ে আশেপাশের এলাকাটা একটু ঘুরে আসলাম। বাড়ির সামনের রাস্তায় কাঁদা জমে গেছে, রাস্তার পাশের ধানক্ষেতে পানি জমে যাওয়ায় ধান গাছগুলোর শুধু মাথা দেখা যাচ্ছে, কারোর পুকুর ডুবে গেছে, কারোরটা ডোবার জন্য আরেকটা বৃষ্টির অপেক্ষায় আছে, কেউ কেউ আবার অন্যের পুকুরের ভেসে আসা মাছ ধরছে। বেশিক্ষণ বাইরে থাকা হলো না, হঠাৎ আরো কয়েকগুণ বেশি বেগে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে আসতে হলো।
এই বৃষ্টি চললো আরো প্রায় দুই ঘণ্টা। এরমাঝে আমি খাওয়া – গোসল সেড়ে নিলাম। বৃষ্টি থামলে ১১টার পর বাসা থেকে বের হলাম। দেখা যাক কতোটুকু যাওয়া যায়।
রাস্তা চেনা হওয়ায়, বাসা থেকে রংপুর সাতমাথা যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা গুলো ফলো করতে করতে হাঁটা শুরু করলাম। গ্রামের রাস্তা ব্যবহার করে সরাসরি মীরবাগে গিয়ে মেইন রোডে উঠলাম। এদিকে রংপুরের একটি স্থানীয় পত্রিকার এক বড় ভাই সকাল থেকে আমার জন্য মীরবাগে অপেক্ষা করছিলেন। ওনার সাথে দেখা করে চা খেতে খেতে প্রজেক্ট নিয়ে ছোট-খাটো একটা সাক্ষাৎকার দিয়ে, ওনাকে বিদায় দিয়ে মেইন রোড ধরে সাতমাথা চলে গেলাম। রাস্তার জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছে, এদিকেও একিরকম বৃষ্টি হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে।
এরপর সাতমাথা থেকে জাহাজ কোম্পানি মোড় হয়ে রংপুর সার্কিট হাউসের দিকে হাঁটা দিলাম। এই পথের মাঝে অবশ্য শশ্মান, পুরাতন বইয়ের দোকান, ডাবের দোকান, গাছের দোকান, সুরভি উদ্যান আর জেলা স্কুলের সামনে কিছু মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হলো।

ডাবের দোকানে ৫০টাকা জোড়া ডাব শুনে লোভ সামলাতে পারলাম না। দুইটা ডাব খাওয়ার চিন্তা করলেও, একটার বেশি খেতে পারলাম না।
সুরভি উদ্যানের সামনে আমার একটা স্কুল বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা, মেয়েবন্ধু নিয়ে এই বৃষ্টির মধ্যে এতদূরে ঘুরতে আসছে। সত্যিই প্রেম মানে না বাঁধা।
যাইহোক, ওরা উদ্যানে ঢুকলো – আমি ওদের দুইজনকে বিদায় দিয়ে সার্কিট হাউজের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। সার্কিট হাউজে পৌঁছে একটা ছবি তুলে, চেক পোস্টের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। চেকপোস্টে ২০ মিনিটের একটা ব্রেক নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার হাঁটা।
হেঁটে হেঁটে চেকপোস্ট থেকে টার্মিনালের দিকে যাচ্ছিলাম আর সময় হিসেব করছিলাম। কোনো ভাবেই হিসাব মেলাতে পারছিলাম না। পার্বতীপুর যাওয়ার প্ল্যান ছিলো, বিকেল ৪টা বাজে তখনও পার্বতীপুর থেকে আমি প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে। ৭/৮ ঘন্টা সময়ের ব্যাপার, যেটা কোনো ভাবেই সম্ভব হচ্ছিলো না। তখন প্ল্যান চেঞ্জ করে AALPS লিডার সাজ্জাদ ভাই, রাকিব ভাই, শাহনেওয়াজ ভাইয়ের এলাকা বদরগঞ্জ পর্যন্ত যাওয়ার প্ল্যান করি।

তারপর সাজ্জাদ ভাইকে কল দিয়ে জানালে উনি শাহনেওয়াজ ভাইয়ের বাড়িতে থাকার বিষয়টা আমাকে জানায়। রংপুর – বদরগঞ্জ – পার্বতীপুর সড়ক ধরে এগুতে এগুতে শাহনেওয়াজ ভাইয়ের বাসায় আমার রাতে থাকার বিষয়টা কনফার্ম করি। শাহনেওয়াজ ভাইয়ের অবশ্য সেম রুটেই সাইক্লিং ট্রেনিং ছিলো।
সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘাঘট প্রয়াস পিকনিক স্পোর্টের সামনে চলে আসলাম। এতোক্ষণ রাস্তার প্রতি তেমন মনোযোগই দেয়ার সময় পাইনি৷ রাস্তাটা বেশ সুন্দর, বৃষ্টি রাস্তাটাকে ভিজিয়ে আরো সুন্দর করেছে। ঘাঘট থেকে একটুদূরেই একটা ব্রিজ, ব্রিজের পাশের জমিতে পানি জমে আছে, কয়েকজন সেখানে মাছ ধরছে। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে আমি হাঁটছি, রাস্তার দুপাশে সবুজ ধানক্ষেত। বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়ে ধান ক্ষেতের সৌন্দর্য্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে গিয়েছে।

আমি নাজিরের হাটের দিকে যাচ্ছি, এখানকার রাস্তা বেশ চওড়া। রাস্তার পাশে একটু পরপর বেশ কয়েকটা নার্সারি। আজকে হাতে সময় নেই, তাই গাছ কেনা হলো না। অন্যদিন গাছ কিনতে আসবো চিন্তা করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতে নাজিরের হাটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল ৫টা পার হয়ে গেছে। নাজিরের হাটে ৫মিনিট থেকে একটা দোকানে মিষ্টি টেস্ট করে আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবারের রাস্তাটা আরো বেশি সুন্দর, রাস্তার দুইধারে আম গাছ আর পাশেই সবুজ ধানক্ষেত। অনেকটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আমবাগানের মতো। এখানে অবশ্য আমগাছের ফাঁকে ফাঁকে একটু দূরে দূরে বটগাছও আছে। আর, ধানক্ষেতের মাঝে মাঝে আঁখক্ষেত।
দুইপাশে সারি সারি আমগাছ ওয়ালা রাস্তা ধরে এগুতে এগুতে হঠাৎ দূর থেকে একজনকে দ্রুত বেগে সাইকেল চালিয়ে আসতে দেখলাম, কাছাকাছি আসার পর আবিষ্কার করলাম আরে ইনিই তো শাহনেওয়াজ ভাই। ভাই তখন ওনার ফাস্ট ল্যাপে ছিলো, সাইকেল স্লো করো দুই-একটা করে গতি বাড়িয়ে সাই করে চলে গেলো।

আমি হাঁটছি আর সারি সারি আমগাছ দেখছি, দূরে মাছ ধরা দেখছি, এভাবে দেখতে দেখতে একটা সময় ডালিয়ার ব্রিজ, অদ্ভুত একটা ব্রিজ এই ডালিয়ার ব্রিজ – সোজা রাস্তার মাঝের ব্রিজের শুরুতে ডানে-বামে দুইটা রাস্তা আবার শেষে ডানে-বামে দুইটা রাস্তা। অর্থাৎ, ব্রিজের দুইপ্রান্তেই চৌরাস্তা। এমনটা কোথাও এখন পর্যন্ত দেখিনি।
হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তখনও বদরগঞ্জ থেকে আমি প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে। ততক্ষণে অবশ্য শাহনেওয়াজ ভাই ইউটার্ন নিয়ে এসে ট্রেনিং থামিয়ে আমার সাথে গল্প শুরু করে দিয়েছে। আমাদের রানারদের মধ্যে দেখা হলে যেগুলান নিয়ে কথা হয় আর কি!! আমি হাঁটছিলাম আর ভাই পাশে আস্তে আস্তে সাইকেল চালাচ্ছে, এভাবে কিছু দূর যাওয়ার পর ওনাকে বাসায় যেয়ে সাইকেল রেখে ফ্রেশ হয়ে অটো নিয়ে আসতে বললে উনি প্রথমে রাজি না হলেও পরে রাজি হলেন।
ভাই বাসার দিকে গেলেন, আমি আবারও একা একা হাঁটছি। একা হাঁটতে হাঁটতে একজন সঙ্গী পেলাম। ওনার নাম সোহরাব আলী, বদরগঞ্জ উপজেলার পাশেই ওনার বাড়ি। পেশায় ভ্যান চালক সোহরাব চাচা নাকি আমাকে অনেক্ষণ ধরে হাঁটতে দেখছেন। এরমাঝে ৩/৪ বার যাত্রী নিয়ে এই সড়কে আপ-ডাউন করেছেন। তারপরও আমি হেঁটেই যাচ্ছি, এটা দেখে উনি খানিকটা অবাকই হয়েছেন। ওনার মাথায় আমাকে নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো, সেগুলোর উত্তর খুঁজতেই আমার কাছে এসে ওনার ভ্যান স্লো করেছেন।

আমি ওনার কাছে আমার হাঁটার বিষয়টা বুঝিয়ে বললাম। উনি শোনার পর আরো অবাক হলো। কিছুক্ষণ আমার সাথে সাথে থেকে, আমাকে শুভকামনা জানিয়ে উনি চলে গেলেন।
আমি আবার একা হয়ে গেলাম। একা একা হাঁটতে হাঁটতে বদরগঞ্জ থেকে বোর্ড বাজারে চলে আসলাম, বোর্ড বাজারে চা খেতে খেতে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এরমাঝে শাহনেওয়াজ ভাই চলে আসলেন, অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় হাঁটা ওখানেই শেষ করে ভ্যানে করে বদরগঞ্জে চলে আসলাম।

রাকিব ভাই আগেই বলিছিলো বদরগঞ্জের নোনি গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টি টেস্ট করতে। শাহনেওয়াজ ভাইকে অবশ্য বলতে হলো না, উনি সরাসরি ওই দোকানের সামনেই ভ্যান নিয়ে যেতে বললেন। রস মঞ্জুরি, হাঁড়িভাঙ্গা আর স্পঞ্জ তিন রকমের মিষ্টি টেস্ট করলাম। এখানের রস মঞ্জুরিটার তুলনা হয় না। হাঁড়িভাঙ্গাটা ইউনিক একটা মাল্টিটেস্ট মিষ্টি। আর স্পঞ্জটা সবার শেষে খাওয়ায় স্বাদটা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। অন্য কোনো দিন গেলে আগে ওটাই টেস্ট করবো।
মিষ্টি খাওয়া শেষ কর ভ্যানে করে ট্যাক্সের হাটে চলে আসি। এখানেই সাজ্জাদ ভাই – শাহনেওয়াজ ভাইয়ের বাসা। আজকে এখানেই থাকছি।
লেখক: মোঃ সোহেল রানা সোহান
4O0KM WALKING CHALLENGE : RANGPUR DIVISION