পলাশবাড়ী – গাইবান্ধা – হরিপুর ঘাট – চিলমারী – উলিপুর
(৫৭.৩০ + ৩.৫৫) = ৬০.৮৫ কিলোমিটার
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া হাঁটার ড্রিম প্রজেক্টের প্রস্তুতি হিসেবে রংপুর বিভাগের সবগুলো জেলা শহরে হাঁটার বিষয়টা নিয়ে হুট করেই প্ল্যান করি। হাঁটার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করার, বাল্যবিবাহ এবং শিশুদের শারিরীক, মানসিক ও অবহেলা জনিত নির্যাতন এর কুফল সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার এবং অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করি৷
অল্প সময়ের ব্যবধানে আমার ব্যক্তিগত খরচ, বৃক্ষরোপণ এবং ছিন্নমূল ও পথশিশুদের খাবারের জন্য কিছু অর্থ সংগ্রহ করি।
যাইহোক, সবরকমের প্রস্তুতি নিয়ে ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু সোয়াদের বাসায় যাই। ওর বাসা গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলায়। যেখান থেকে পরেরদিন আমার হাঁটা শুরু করার পরিকল্পনা। রাতে সোয়াদের বাসাতেই ছিলাম।
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০; ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠাই ছিলো আজকের দিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ জয় করে ৫টার মধ্যে উঠেছি এটাই দিনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এক্ষেত্রে অবশ্যই আঙ্কেলের অবদান ই সবচেয়ে বেশি উনি আমাকে আমার অ্যালার্মের আগেই ডেকে দিয়েছেন। যাইহোক, উঠে ফ্রেশ হয়ে আন্টির বানানো নাস্তা খেয়ে ঠিক ৫টা ৩০ মিনিটে বাসার সবাইকে বিদায় জানায়ে হাঁটা শুরু করি। সোয়াদ অবশ্যই শুরুর ২ কিলোমিটার সঙ্গ দিয়েছে। পলাশবাড়ী – গাইবান্ধা মহাসড়কে আমাকে উঠায় দিয়ে ও বাসায় চলে যায়। ও চলে যাওয়ার পর মনে পড়ে, ওর সাথে কোনো ছবিই তো তোলা হয়নি।

এই আফসোস নিয়েই হাঁটতে থাকি অসম্ভব সুন্দর পলাশবাড়ী – গাইবান্ধা মহাসড়ক ধরে। সত্যিই রাস্তাটার প্রেমে পড়ে গেছি, একদম প্রথম দেখায় প্রেমে পড়া যাকে বলে। কেনো জানি মনে হচ্ছিলো একটু দ্রুতই হাঁটছি, একের পর এক কিলোমিটার পোস্ট অতিক্রম করে। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজের মাঝে অবশ্য মাথা উঁচু করে একটু পরপর জোড়ায় জোড়ায় ইটের ভাঁটা দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা যায়, অন্য জায়গার থেকে একটু বেশিই ইটের ভাটা এখানে। গাইবান্ধা শহরকে ইটের ভাটার শহর বললেও ভুল হবে না।
গাইবান্ধা সার্কিট হাউস থেকে ২ কিলোমিটার দূরে থাকতেই আমার আরেক বন্ধু রাকিবকে বলে রেখেছিলাম ওখানে থাকতে, সার্কিট হাউস পৌঁছানোর পর রাকিব আমাকে রিসিভ করে কয়েকটা ছবি তুলে দেয়। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা ৯টা ছুঁই ছুঁই, ২০ কিলোমিটার হাঁটা হয়ে গেছে।
রাকিব আমাকে গাইবান্ধা শহর ঘুরিয়ে দেখালো। তারপর গাইবান্ধার স্পেশাল রস মন্জুরি খাওয়ায়, কয়েকটা পিনাটবার কিনে দিয়ে সুন্দরগঞ্জ রোডে তুলে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। এরপর আসলো আরেক বন্ধু নাঈম, ঘাঘটা নতুন ব্রীজে ওর সাথে দেখা করলাম। এরপর ও চলে গেলে সুন্দরগঞ্জ রোড ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু রাস্তায় দুই ধারে গাছ থাকায় ততোটা অনুভব হচ্ছিলো না।

এই সড়ক ধরে কিছুদূর যাওয়ার পর আমার বান্ধবী অর্নার সাথে দেখা করি, ওর কাছে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন দুইটা শিশুর খোঁজ পাই। রাস্তায় পাশেই বাসা শুনে ওদের জন্য জন্য চিপস আর চকলেট নিয়ে ওদের বাসায় যাই। মুহূর্তেই বাচ্চা দুইটার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলি। ওদের একজন খুব ভালো ছবি আঁকে, আরেকজন খুব সহজেই বিভিন্ন তারিখ এর ঘটনা মনে রাখতে পারে। ওদের দুজনের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করি। অর্নাকে বিদায় জানিয়ে এবার যাচ্ছি, বন্ধু শুভর বাসায়। শুভর বাসা সুন্দরগঞ্জের হরিপুরে। ওখানেই আমার দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
শুভ আমার জন্য ওর বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার সামনের একটা বাজারে অপেক্ষা করছিলো। বাজারের নাম পাঁচপীর বাজার। পাঁচপীর বাজারে শুভর সাথে দেখা করে, বাকীটা পথ একসাথে হেঁটে ওর বাসায় যাই।
শুভর বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৩টা বেজে যায়, এদিকে প্রায় ৫১ কিলোমিটার হাঁটা হয়ে যায়। শুভর বাসায় গোসল করে, খেয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ৪টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ি হরিপুর ঘাটে যাওয়ার উদ্দেশ্য। ওখান থেকে চিলমারী যাওয়ার নৌকা পাওয়া যায়।
শুভকে নিয়ে একটু বলি, শুভ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু নাঈমের বন্ধু। নাঈমের মাধ্যমে গতকাল রাতে শুভর সাথে আমার পরিচয়। এতো অল্প সময়ের ব্যবধানে কেনো জানি শুভকে বেশ আপন মনে হয়েছে। শুভর সাথে গল্প করতে করতে ৩০ মিনিটের মধ্যে ঘাটে পৌঁছে যাই।
কিন্তু, ঘাটে গিয়ে জানতে পারি নৌকা ছাড়তে দেরি হবে। কি আর করার, ঘাটের আশেপাশে কতক্ষণ ঘুরাঘুরি করেই কাটিয়ে দিলাম। মাঝে অবশ্য একবার চা খেলাম। নৌকা ছাড়তে দেরি করায় যেটা হয়েছে, প্রথমবার বাঁশের নৌকা দেখেছি। একদল লোক বাঁশের নৌকায় করে ফরিদপুর যাচ্ছিলো। বাঁশের নৌকার কথা আগে অনেক শুনেছি, সামনাসামনি এবারই প্রথম দেখা।

যাইহোক, প্রায় দেড় ঘন্টা পর সাড়ে পাঁচটার দিকে নৌকা ছাড়ে। নৌকায় করে প্রথম গন্তব্য হরিচরি ঘাট। এই নাম নিয়ে পরে বলছি। নৌকা থেকে হরিচরি চরের বাড়িগুলোকে ছবির মতো মনে হচ্ছিলো। নদীর চরে অনেকেই ঘোড়া, মহিষ চড়াতে নিয়ে এসেছিলো এই দৃশ্যও ছিলো দেখার মতো। এবার আসি হরিচরি নাম নিয়ে, এই চর মূলত হরিপুর আর চিলমারীকে ভাগ করেছে। এখানে, হরিপুর থেকে এসেছে হরি আর চিলমারী থেকে এসে চরি, দুয়ে মিলে হয়ে গেছে হরিচরি।
যাইহোক, হরিচরির ঘাট থেকে নৌকা বদলিয়ে এবার যেতে হলো জামতলা ঘাটে। এখানে অনেক সরু হয়ে গেছে নদী। যার দুই পাশে চর। আশেপাশের মানুষ নদীতে গোসল করছে, থালাবাসন মাজছে, মাছ ধরছে, গবাদিপশুকে গোসল করাচ্ছে – আমি শুধু দেখেই যাচ্ছি। জামতলা ঘাটে নৌকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা। ওখানে অপেক্ষা করছিলো ভার্সিটির একজন সিনিয়র বড় ভাই আর ওনার বন্ধু। ওনাদের সাথে গ্রামের ভিতর দিয়ে মাটির রাস্তা, বাঁধের উঁচু রাস্তা পাড় হয়ে যখন চিলমারী বাজারের কাছাকাছি যাই। তখন প্রায় সন্ধ্যা ৭টা বেজে গেছে।
ওনারা আমাকে চিলমারীতেই থেকে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমার উলিপুরে আসতেই হবে জানার পর ওনারা আমাকে অটোরিকশাতে আসার পরামর্শ দেন। কিন্তু, আমি ওনাদেরকে আমার ব্যাগ দিয়ে উলিপুর পর্যন্ত দৌড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট সময় নিয়ে ১৩ কিলোমিটার দৌড়িয়ে উলিপুরে আসি। (এই ১৩ কিলোমিটার যোগ করিনি।)

উলিপুর এসে ওনাদের দুইজনকে বিদায় দিয়ে, রেজাউল ভাইয়ের সাথে দেখা করি। ওনার কাছেই আমি আজকে রাতে থাকবো। দুইভাই মিলে উলিপুর শহরের একটা অংশ ঘুরে রাতের খাবার খেয়ে রুমে চলে আসি। রুমে আসার আগ-মুহূর্তে অবশ্য উলিপুরের স্পেশাল ক্ষীরমণ মিষ্টি টেস্ট করেছি। এটা বেশ ভালো ছিলো।
বৃক্ষরোপণ আপডেট: আজকে পলাশবাড়ীতে ১০টি মেহগনি, গাইবান্ধায় ৪টি নিম, পাঁচপীরের বাজারে ২টি মেহগনি এবং কাউনিয়ায় ২০ টি জলপাই – মেহগনি – নিম গাছ লাগানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত লাগানো মোট গাছের সংখ্যা ৩৬।
লেখক: মোঃ সোহেল রানা সোহান
4O0KM WALKING CHALLENGE: RANGPUR DIVISION