জাপান থেকে আনা বিলাসবহুল জাহাজ পৌঁছে গেছে বাংলাদেশে, এ খবর এখন পুরণোই। বাংলাদেশে এ ধরণের জাহাজ চলবে এ খবরে উচ্ছোসিত পর্যটকরা। এছাড়া কক্সবাজার থেকে সরাসরি সেন্টমার্টিন যাওয়ার বিষয়টাও এবছর চালু হয়েছে কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের হাত ধরে। ভাড়া নিয়ে আপত্তি থাকলেও ভালোই চলছে জাহাজটি। এ অসময়েও সেন্টমার্টিন যাওয়া যাচ্ছে এই জাহাজে বিষয়টা অনেক পর্যটকের জন্য আনন্দের। কিন্তু আমার মাথায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিন্তা এসেছে, কোন দিকে যাচ্ছে সেন্টমার্টিনের পর্যটন?
২৪ সেপ্টেম্বর ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় সেন্টমার্টিনের প্রবালের আশংকাজনক হ্রাস নিয়ে একটি প্রতিবেদন এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে প্রবাল শূণ্য হতে যাচ্ছে এ দ্বীপ। এ আশংকা প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গবেষক। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে দ্বীপটির প্রবাল আচ্ছাদন ১.৩২ বর্গকিমি থেকে নেমে এখন ০.৩৯ বর্গকিমি আছে। কাগজে কলমে দ্বীপের আয়তন ১৩ বর্গকিমি বলা হলেও এখনকার আয়তন ৯ বর্গকিমি। ছোট্ট এ দ্বীপে প্রতিবছর প্রায় দেড়লাখ পর্যটক যায়।

প্রবাল পাথর, চোখ ধাধানো নীল সমুদ্রের পানি আর নারিকেলের সারি নিয়ে এ দ্বীপটি ভ্রমণপ্রিয় মানুষের পছন্দের শীর্ষে আছে। প্রতিবছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে অক্টোবর থেকে শুরু করে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত পর্যটকরা ভিড় করে এই দ্বীপে। একদিনে দশ হাজার লোকেরও সমাগম ঘটে এখানে। তিন দিনের বন্ধ আর ডিসেম্বরের শেষ দিকে পর্যটকদের ভিড়ে নুয়ে থাকে এ দ্বীপ। পর্যটন মৌসুমে ৫-৬ টি জাহাজ ও ট্রলারে করেও পর্যটকরা যায় এ দ্বীপে। এবছর সেই সাথে যুক্ত হয়েছে কক্সবাজার থেকে যাওয়ার কর্ণফুলী এক্সপ্রেস। আবার জাপান থেকে আনার জাহাজও চালু হবার কথা সামনের মাসেই।
অথচ গত কয়েকবছর ধরে এ দ্বীপটি অন্তত তিনবছরের জন্য পর্যটকদের জন্য বন্ধ করে দেবার কথা ছিলো। প্রতিবারই এ ধরণের কথা উঠে এবং শেষ পর্যন্ত এ মৌসুমেই শেষবার যাবে পর্যটকরা এ হুজুগ তুলে আরো ভিড় বাড়িয়ে দেয়। সেন্টমার্টিনে কোন পাকা স্থাপণা করা যাবেনা, পরিবেশ অধিদপ্তরের এ ধরণের নির্দেশনা থাকলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। বরং গড়ে উঠেছে ১৩০ টি হোটেল ও রিসোর্ট। প্রতিবছর তাদের স্থাপনা সরিয়ে নিতে বলে দায়সারা একটি চিঠি দিয়েই কর্তব্য শেষ করা হয়।

অপসারণ তো পরের কথা নতুন নতুন হোটেল রিসোর্ট গড়ে উঠছে সেখানে। একই সাথে প্রবাল দ্বীপটি ভার বহন করতে না পারার যুক্তিতে পাকা স্থাপণা করার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেখানে গড়ে উঠছে ২/৩ তলা ভবনও। সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার সুবিধার্থে দ্বীপে রাত ১১ টার পর জেনারেটর বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছিলো, এখনতো বেশিরভাগ হোটেলেই সারারাত বিদ্যুৎ থাকে। আর আমাদের পর্যটকদের পরিবেশ বিষয়ক জ্ঞানের কথা নাইবা বললাম।

এ দ্বীপে স্বভাবতই বর্জ্য নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। প্রতি বছর পর্যটকরা ইচ্ছেমতো বর্জ্য ফেলে যায় এ দ্বীপে, যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে প্লাস্টিকের বর্জ্য। অন্য কোন দেশ হলে এ ধরণের দ্বীপে ত্রিসীমানায় কাউকে প্লাস্টিকের কোন কিছু নিয়ে ঢুকতে দিতোনা। পর্যটক আর দুষণের ফলে মরতে শুরু করেছে প্রবাল। আজ থেকে ১০ বছর আগেও সেন্টমার্টিনের আশেপাশে ঢুব দিলে কিছু জীবিত প্রবাল দেখা যেতো, এখন সেগুলোর অস্তিত্ব নেই। মরে যাচ্ছে আমাদের অমূল্য দ্বীপটা, এটা বোঝার জন্য পরিবেশ বিজ্ঞানী হবারও দরকার নেই।
কিছুদিন আগে বলা হয়েছিলো রাতে পর্যটকরা যাতে না থাকতে পারে সেটার ব্যবস্থা করা হবে। তারপর বলা হয়েছিলো প্রতিদিন কতজন যেতে পারবে সেটার একটা কোটা নির্ধারণ করা হবে, সেই অনুসারেই পর্যটকরা যেতে পারবে সেখানে, জানিনা এ সমস্ত পরিকল্পণা কোথায় আছে এখন, আদৌ আছে কিনা আর। বরং প্রতিবছরই সেন্টমার্টিনের জন্য নতুন নতুন জাহাজ যুক্ত হচ্ছে। সে সমস্ত জাহাজে অবশ্য পরিবেশ বিষয়ক অনেক জ্ঞান দেয়া হয় পর্যটকদের, কিন্তু তারা সেটা কীরকম পালন করে সেটা গাংচিলকে চিপস খাইয়ে চিপসের প্যাকেট পানিতে ছুড়ে মারা দেখেই বোঝা যায়।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভিত্তিই হচ্ছে প্রবাল পাথর। গবেষকরা আশংকা করছেন এভাবে চললে ২০৪৫ সালের মধ্যে পুরোপুরি প্রবালশূণ্য হয়ে যাবে দ্বীপটি। আর প্রবাল না থাকলে সমুদ্রের বুকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি। ধ্বংসের হাত থেকে এ দ্বীপকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় এক্ষুণি অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের লাগাম টেনে ধরা। প্রতিবছর যে গুঞ্জণ উঠানো হয় তিন বছরের জন্য পর্যটকদের জন্য বন্ধ করা হবে দ্বীপটি, প্রথম কাজই হচ্ছে এটা বাস্তবায়ন করা।

তিনবছর বন্ধ থাকা অবস্থায় সত্যিকারের অবস্থা নিরুপণ করে প্রতিদিন কতজন পর্যটক যেতে পারবে সেটা নির্ধারণ করে দেয়া। রাতে থাকার ব্যবস্থা হওয়া উচিত তাঁবু, বাঁশ কিংবা কাঠের কটেজে, কোন অবস্থাতেই কোন ধরণের পাকা স্থাপণা থাকা যাবেনা। যারা ডে-ট্রিপে যাবে জন্য যাবেন তাদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে পর্যটকরা দ্বীপে যাওয়ার সুযোগ পাবে তাদের পরিবেশ জ্ঞানের উপর পরীক্ষা নেয়া, যদি সেটাতে উত্তীর্ণ হয় তবে যেতে পারবে দ্বীপে।
অথবা এমন বড় অংকের জরিমানার ব্যবস্থা রাখা যাতে পরিবেশ দূষণের কথা চিন্তাও করতে না পারে। প্লাস্টিক বন্ধ করতে হবে জাহাজে উঠার আগেই। সেন্টমার্টিনগামী জাহাজে উঠার সময়ই নিশ্চিত করতে হবে কারো কাছে কোন প্লাস্টিকের কিছু নেই। এধরণের ব্যবস্থা নেবার আগেই এ দ্বীপে গণ-পর্যটন চালু রাখার মানে হচ্ছে এই দ্বীপকে নিশ্চিহ্ন করার ব্যবস্থা করা। আমার মনে হয় এখনো সময় আছে, এখনো চাইলেই করা সম্ভব, কিন্তু সে ধরণের পদক্ষেপ নেয়ার ইচ্ছা, সক্ষমতা বা পরিকল্পণা আমাদের আছে কি?
ফিচার ছবি: লেখক