সারাদিন মেঘ বৃষ্টির লুকোচুরির পরে এখন বৃষ্টি কিছুটা থেমেছে। এখনো ক্ষণে ক্ষণে মেঘের উড়াউড়ি চলছে। তবে বৃষ্টি নেই অনেক সময় হলো। হঠাৎ মেঘ কেটে গিয়ে আকাশ অনেকটা পরিষ্কার মনে হলো। ফুরফুরে হাওয়া বইছে দক্ষিণ দিক থেকে। সন্ধ্যে এখনো নামেনি। তবে সূয্যি মামা অস্ত গেছেন কিন্তু তার সোনালী আভা এখনো ছড়িয়ে রয়েছে দিক থেকে দিগন্তে।

গোধুলি লগ্নের শেষ বিকেলে তাঁবুর দড়জায় বসে প্রিয় বইটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। বাতাসের সোদা ঘ্রাণ তখনো মুছে যায়নি। বৃষ্টিস্নাত পাহাড়, গাছপালা সোনালী আলো মেখে এক মায়াবী রুপ ধারণ করেছে। হঠাৎ করেই মনে ভেসে উঠলো শ্রীকান্ত আচার্যের ভরাট গলায়–
‘আমার সারাটা দিন,মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম।’

কিন্তু চারপাশে হৈচৈ আর কোলাহল শুনে ঘোর কাটলো। আমরা যখন দুপুরে চূড়ায় উঠেছিলাম তখন এসে মাত্র দুইজন লোক দেখেছিলাম। তারপর আমরা সাথে নিয়ে আসা দুপুরের খাবার খেয়ে তাঁবু সেট করলাম একপাশে গাছতলায়। শরীরকে কিছুটা চনমনে ভাব আনার জন্য চা তৈরি করে পান করলাম সবুজের মিশেলে। তখনো পর্যন্ত দুয়েকটা তাঁবু সেট করা হয়েছিলো। কিন্তু সন্ধ্যায় যখন তাঁবু থেকে বের হলাম আশেপাশে দেখেই তাজ্জব বনে গেলাম।

চারিদিকে লোকে লোকারণ্য, কোলাহল হৈচৈ। নির্জন নিরিবিলি একটা জায়গা মুহূর্তেই কোলাহলপূর্ণ হয়ে গেলো। এমনকি ক্যাম্পিং সম্পর্কে যাদের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি নেই এমন লোকসংখ্যাও কম নয়। অনেকের কাছ থেকেই শুনতে পেলাম এখানে আসা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক হয়েছে। কে কোথায় ঘুরতে যাবে বা কোথায় গিয়ে শান্তি পাবে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে হয় আমার কাছে। সবার মন সব জায়গায় গিয়ে শান্তি পায়না। আবার এরকম জায়গায় আরামপ্রিয় পর্যটকরা গিয়েও যন্ত্রণা ভোগ করেন। তাই কোথায় যাবেন, কেনো যাবেন এই প্রশ্ন নিজেকে করা উচিৎ ভ্রমণ পরিকল্পনা করার পূর্বে।

কোলাহলে আহত হয়ে জাদির পাশে চলে গেলাম যেখানে কোনো তাঁবু সেট করা হয়নি। মেঘেদের লুকোচুরি, উড়াউড়ি চলছিলো পুরোদমে। একদল মেঘ উড়ে আসে আবার তাদের পিছু পিছু আরেকদল মেঘ উড়ে আসে। এরকম ভাবে চমৎকার সব দৃশ্য দেখছিলাম আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম। এর আগে অনেক জায়গায় মেঘ দেখেছি, কিন্তু মেঘের ছোয়া কোথাও পাইনি যেটা মারায়নতং চূড়ায় পেয়েছি। আমরা দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ করে মেঘ এসে ঢেকে দিলো আমাদের পরক্ষণেই আবার উড়ে চলে গেলো। এরকম বিচিত্র সব অনুভূতি অর্জন করলাম আলীকদমের এই পাহাড়ে।

সন্ধ্যা বেশ জাকিয়ে নেমেছে, হাল্কা এক পশলা বৃষ্টি এসে আবহাওয়ার পূর্বাভাসকে শতভাগ সঠিক প্রমান করার চেষ্টা করলো। আমরাও accuweather.com এর প্রতি বিশ্বস্ত হলাম পূর্বাভাস মিলে যাওয়াতে। সন্ধ্যার পরপর আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা আর রইলো না, আকাশ বেশ পরিষ্কার। প্রভারনা পূর্নিমার প্রকাণ্ড চাদটা আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হলো রাতের আকাশে। অন্ধকার ভেদ করে গগনবিদারী ঝলমলে আলোয় ভাসিয়ে দেওয়া শুরু করলো সমস্ত পাহাড়, গাছপালা আমাদের ক্যাম্পসাইট। তখনো কিছু কিছু লোকজন চূড়ায় পদার্পণ করছে, তাঁবু সেট করা চলছে। আমরা চাদের আলোয় ভিজে ভিজে পাহাড়ের হিমশীতল বাতাসে উষ্ণ হওয়ার জন্য তুফান বাতাসেও আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছিলাম।

রাত ৮ টা বাজে, দক্ষিণ পাশটাতে কোনো তাঁবু নেই, তাই আগুন জ্বালানোর জন্য এটাই উপযুক্ত জায়গা কিন্তু এই পাশটাতেই বাতাস সবচেয়ে বেশি। শরীফ ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে আসা পেনি স্টোভের জ্বালানীটা বিকেলে চা বানানোর পরেও অর্ধেকের বেশি রয়ে গেছে। রাতের ডিনার হবে কাপ নুডলসে, সেটার জন্য গরম পানি করবো আর ডিম সিদ্ধ হবে। ক্যাম্প-ফায়ারের আগুন জ্বালানো হলে পেনি স্টোভ লাগবেনা তাই স্প্রিরিট দিয়েই চেষ্টা করা হচ্ছে ভেজা কাঠে তুফান বাতাসে আগুন জালানোর। অনেক সময় চেষ্টা করেও যখন স্প্রিরিট শেষ প্রায় তখন অন্য ক্যাম্পারদের চুলা থেকে আগুন নিয়ে এসে মাত্র আমাদের আগুনটা জ্বলে উঠলো তখন রাজন ভাইয়ের চেহারা ছিলো যুদ্ধজয়ী সেনাপতির মতো। এই আগুন জ্বালানোর জন্য বেচারার কতো কষ্ট।

এরমধ্যে তাহান ভাইকে তাঁবুতে পাঠানো হলো ডিম নিয়ে আসার জন্য, ঠিক এই সময়ে পটকা বা ফাকা গুলির শব্দ পাওয়া গেলো। আমরা ভেবেছিলাম ক্যাম্পারদের মধ্যে কেউ হয়তো বাজি ফুটাচ্ছে। কাপ নুডলসে মাত্র গরম পানি ঢেলে দেওয়া হয়েছে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তাহান ভাই দৌড়ে আসলো এবং বললো সেনাবাহিনী আসছে তারা মিস ফায়ার করতেছে তাঁবু গোটানোর জন্য পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছে। কয়েকটা তাঁবুতে বন্দুক দিয়ে আঘাতও করেছে। আমি বুঝতে পারলাম এবং তাঁবুর দিকে দৌড় দিবো কিন্তু রাজন ভাই মনে করলো তাহান মজা করতেছে। যখন আমি দৌড় দিলাম তখন সেও দৌড় দিলো। আমি গিয়ে দেখি আমাদের ক্যাম্প সাইটের চারপাশে ঘিরে রেখেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদাদিক ডিভিশনের সদস্যরা, ঠিক আমার আগের তাঁবুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন তার কাছে সিনিয়রের খোঁজ নিলাম, তিনি একজন সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসারকে দেখিয়ে দিলেন। তার সাথে কথা বলে জানলাম নিরাপত্তা ইস্যুতে এখানে কাউকে থাকতে দেওয়া হয়না, কিন্তু লোকাল গাইডরা ক্যাম্প ফাঁকি দিয়ে লোকজনকে নিয়ে আসে। আজকে সর্বমোট ১০২ জন আসছে অবস্থান করার জন্য যা অস্বাভাবিক।

তারাহুরো করে তাঁবু গোছানো হলো, কার ব্যাগে কি ঢুকেছে এতটুকু বুঝে উঠার সময় ছিলোনা। দশ মিনিটের মধ্যে ব্যাগ গোছানো হলো, সবার নামের তালিকা তৈরি করা হলো এবং সবাইকে ডেকে ব্রিফিং করা হলো। প্রথমে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে আলীকদম ক্যাম্পে। রাত ৯ টায় সবাই যাত্রা শুরু করলাম। যখন আমরা নেমে আসা শুরু করলাম পিছনে ফেলে আসলাম তেজোদ্দীপ্ত চাদটাকে। আমাদেরকে অন্ধকারে পথ খুঁজে নিতে সহায়তা করার জন্যই হয়তো বিলিয়ে দিচ্ছিলো সর্বশক্তি দিয়ে আলো। এরকম চাদের আলো খুব কম সময়ই দেখা যায়।
হুমায়ুন আহমেদের ভাষায়-
সেইটা ছেল চান্নি-পসর রাইত। আহারে কি চান্নি। আসমান যেনো ফাইট্টা টুকরা টুকরা হইয়া গেছে। শইলের লোম দেহা যায় এমন চান্দের তেজ।

এরকম এক রাতে আমরা নেমে আসলাম মারায়নতং চূড়া থেকে, দুই ঘণ্টার মহা যন্ত্রণাদায়ক এক যাত্রায় পিছলে পড়া, আছাড় খাওয়া, হাত পা কাটা, স্লাইয় খেয়ে কয়েকফুট চলে যাওয়া খুব সাধারণ বিষয় হয়ে গেলো। রাত ১১ টায় নেমে আসলাম আবাসিক বাজার সেখানে থেকে সবাইকে ক্যাম্পে নেওয়া হয়নি যার যেখানে চলে যাওয়া বা রাতে থাকা সম্ভব সেখানেই ব্যবস্থা করে দিচ্ছিলো সেনাবাহিনীর সদস্যরা। আবাসিক বাজারেই এক বাসায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। রাত কাটালাম চরম ক্লান্তি নিয়ে। কিন্তু অপূর্ণ এক আকাঙ্কা রয়ে গেলো মনে মারায়নতং চূড়া থেকে সূর্যোদয় দেখা। (সমাপ্ত)
ভ্রমণকালীন সময়ে আমাদের ব্যবহৃত কোনো প্লাস্টিক বা অপচনশীল পণ্য আমরা ফেলি আসিনি, বয়ে নিয়ে এসেছি নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত। সবাই সচেতন হলেই রক্ষা পাবে পরিবেশ।
ভ্রমণগুরুতে প্রকাশিত আমার সব পোস্ট দেখুন এই লিঙ্কে:
https://www.vromonguru.com/author/jewel/